• ‘আমাদের আছে লক্ষ্মীর ভান্ডার, ওদের আছে দুর্নীতির ভান্ডার’, মোদীকে খোঁচা মমতার
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৯ আগস্ট ২০২৫
  • বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে রাজ্যে। বৃহস্পতিবার মেয়ো রোডে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) প্রতিষ্ঠা দিবসের মঞ্চ থেকে বিজেপি, বাম এবং নির্বাচন কমিশন—তিন পক্ষকেই একযোগে তীব্র আক্রমণ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা, ‘জীবন থাকতে কারও ভোটাধিকার কেড়ে নিতে দেব না।’ পাশাপাশি দুর্নীতি ও পরিবারতন্ত্র ইস্যুতে কেন্দ্রের মোদী সরকারকে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন মমতা। এজন্য তিনি মোদী ও অমিত শাহকে একযোগে আক্রমণ করেছেন। নেতাজি ও অন্যান্য অনিয়মের ইস্যুতে আক্রমণ করেছেন বাম শিবিরকেও।

    প্রসঙ্গত, ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা ‘স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন’ নিয়ে তোলপাড় দেশজুড়ে। বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, এই প্রক্রিয়াকে হাতিয়ার করে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ভোটার তালিকায় কারচুপি করছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিহারে ভোটের আগে এই সংশোধন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে প্রবল রাজনৈতিক বিতর্ক। বিহারে এসআইআর (স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন) প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর বাংলাতেও ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধনের জল্পনা তৈরি হয়েছে।  বাংলাতেও বিরোধিতার ঝড় তুলেছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের অভিযোগ, আসল ভোটারদের নাম বাদ দিয়ে তালিকায় ভুয়ো নাম ঢোকানো হচ্ছে।

    এই প্রসঙ্গেই বিজেপিকে তীব্র আক্রমণ করেন মমতা। তাঁর অভিযোগ, ‘এসআইআর-এর নামে বাংলায় এনআরসি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ভোটার তালিকা থেকে গরিব মানুষের নাম বাদ দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, জীবন থাকতে কাউকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে দেব না।’

    বৃহস্পতিবার মেয়ো রোডে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ইস্যুতে সরাসরি কেন্দ্র ও নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ করে বলেন, ‘যতই চক্রান্ত করুক, কোনও লাভ হবে না। সারা ভারত থেকে ৫০০-রও বেশি টিম এনে তালিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে, যাতে মানুষের নাম বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু বাংলার মানুষ কোনও অন্যায় মেনে নেবে না।’

    তিনি রাজ্যবাসীকে সতর্ক করে বলেন, ‘তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করছে, যাতে আপনার নামটা বাদ দেওয়া যায়। তাই কেউ সার্ভে করতে এলে কোনও তথ্য দেবেন না।’ তিনি আরও সতর্ক করেন, ‘বাড়ি বাড়ি সমীক্ষার নামে আপনার সম্পর্কে সব খুঁটিনাটি তথ্য নেওয়া হচ্ছে। তার পর ভোটার তালিকা থেকে নাম মুছে দেওয়া হবে। তাই সবাই নিজের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখে নিন, আপনার নাম রয়েছে কি না। আধার কার্ডটা করে রাখুন। ওটা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে।’

    মমতা নির্বাচন কমিশনকে সম্মান জানালেও তাদের ভূমিকা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন, ‘ইলেকশন কমিশনের চেয়ারকে আমি সম্মান করি। কিন্তু বড়রা যদি ললিপপ খান, তাহলে তা মানায় না।’ জাতীয় নির্বাচন কমিশনের প্রতি কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন এলেই দেখবেন এজেন্সির দাপাদাপি বাড়ে। নির্বাচন এলেই দেখবেন এজেন্সির দাপাদাপি বাড়ে। আগে কখনও কোনও রাজনৈতিক দল এভাবে কেন্দ্রীয় এজেন্সি ব্যবহার করেনি। কিন্তু এখন সবটাই করছে বিজেপি।’

    মমতা এসআইআর ইস্যুতে রাজ্য প্রশাসনকেও ‘ভয় দেখানোর’ অভিযোগ করেছেন নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রের মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক আধিকারিকদের হেনস্তার অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর কটাক্ষ, ‘ডিএম, বিডিও, পুলিশ— সবাইকে ভয় দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে চাকরি খেয়ে নেব, জেলে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইলেকশন কমিশনের আয়ু মাত্র তিন মাস। ওরা আসে আর যায়। গায়ের জোরে কিছুই হবে না।’

    এদিনের সভায় দলের ছাত্র-যুবদের সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘নিজেদের ভোটার তালিকা একবার দেখে নিন। আধার কার্ড আপডেট করে রাখুন। কারণ ওরা অন্যের তথ্য নিয়ে গিয়ে ভোট কেটে দিতে পারে। তাই সতর্ক থাকুন, যাতে কেউ আপনার অধিকার কেড়ে নিতে না পারে।’

    মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের গরিব ও শ্রমিকদের পাশে থাকার বার্তা দেন। তিনি ভিনরাজ্যে কাজ করা বাংলার শ্রমিকদের দুর্দশার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন। তাঁর অভিযোগ, ‘বাংলার গরিব শ্রমিকদের বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে, তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমি গরিব মানুষের সঙ্গে আছি, আমি জাত-পাত মানি না। গরিব মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে আমার হৃদয় জড়িয়ে আছে।’

    বিজেপির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তুলে তৃণমূল সুপ্রিমো বলেন, ‘আমাদের আছে লক্ষ্মীর ভান্ডার, আর ওদের আছে দুর্নীতির ভান্ডার।’ তিনি কেন্দ্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আমাদের কাছেও অনেক ফাইল আছে। দরকার হলে সব ফাঁস করে দেব।’ মোদী সরকারকে নিশানা করে তাঁর কটাক্ষ, ‘মোদীজি সারাক্ষণ দুর্নীতির কথা বলেন, অথচ সারা দেশে যেখানে যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় আছে, সেখানে দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর গুজরাত মডেলই আসল চিত্র।’

    এরপরই মুখ্যমন্ত্রী পরিবারতন্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। তাঁকে সরাসরি উদ্দেশ করে মমতা বলেন, ‘আপনি পরিবারতন্ত্রের কথা বলেন, অথচ আপনার ছেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না থাকলেও সর্বত্র আপনাদের পরিবারের ছড়াছড়ি। ললিপপ দিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখছেন, অথচ অধিকার কেড়ে নিচ্ছেন।’

    এদিন মমতার আক্রমণের মুখে পড়েন বামেরাও। কেরলে বাম শাসিত সরকারের বিরুদ্ধে নেতাজি নিয়ে ভুল তথ্য পড়ানোর অভিযোগও তোলেন তিনি। মমতার বক্তব্য, ‘নেতাজি ইংরেজদের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন— এমন মিথ্যা তথ্য কেরলের বইয়ে পড়ানো হচ্ছে। যাঁরা মানুষের ইতিহাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায়, তাঁদের রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।’

    উল্লেখ্য, রাজনৈতিক মহলের মতে, মমতার এদিনের ভাষণ নিছক দলীয় ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানের বক্তব্য নয়, বরং আগামী বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিরই স্পষ্ট ইঙ্গিত। ২১ জুলাই মঞ্চ থেকেই নির্বাচনমুখী সুর বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবারের বক্তব্যে সেই সুর আরও জোরালো করলেন তৃণমূলনেত্রী, যা রাজ্য রাজনীতিতে নতুন করে রাজনৈতিক উত্তাপ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের মতে, মমতার এই মন্তব্যের মধ্য দিয়েই কেন্দ্র ও কমিশনের উপর চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি রাজ্যের ভোটারদের সতর্কবার্তা দিয়েছেন মমতা। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতিটি বুথে তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত করতে হবে, যেন আসল ভোটারদের নাম তালিকায় অক্ষুণ্ণ থাকে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)