আজকাল ওয়েবডেস্ক: আধুনিক যুগে যখন এক ক্লিকেই খবর পৌঁছে যায় সারা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, তখনও পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে প্রতিদিন হাঁটেন এক মানুষ—কালিপদ মুরা। বয়স সত্তরের কোঠায়, শরীর ভঙ্গুর, তবু হাতে চিঠির পুঁটলি আর চোখেমুখে অদম্য দৃঢ়তা। গ্রামবাসীর কাছে তিনি শুধু ডাক বাহক নন, তিনি আশা, সম্পর্ক আর ইতিহাসের ধারক।
একসময় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ছিলেন ডাক-হরকারা। ঝুলি কাঁধে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে অরণ্য আর পাহাড় পেরিয়ে তারা পৌঁছে দিত মানুষের খবর—কখনও উৎসবের আনন্দ, কখনও শোকবার্তা। আধুনিক ডাকবাহন, রেলপথ, মোবাইল ফোন এই প্রথাকে প্রায় বিলুপ্ত করেছে। কিন্তু অযোধ্যা পাহাড়ের দুর্গম গ্রামগুলোতে এখনো এই কাজ বয়ে নিয়ে চলেছেন কালিপদ মুরা।
১৯৮৪ সাল থেকে অযোধ্যা হিলটপ পোস্ট অফিসে কাজ করছেন তিনি। প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা হেঁটে বা দৌড়ে পৌঁছে দেন চিঠি, মানি-অর্ডার, পার্সেল। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি—কোনও বাধাই তাঁকে থামাতে পারেনি। অথচ সরকারি চাকুরিজীবী হয়েও তাঁর পরিচয় এখনো “দৈনিক মজুর”, স্থায়ী কর্মীর মর্যাদা পাননি। পোস্টমাস্টার বিবেক মাহাতো নিজেই স্বীকার করেছেন—“কালিপদবাবু শেষ দিন পর্যন্ত দৈনিক মজুর হিসেবেই কাজ করবেন।”
কালিপদের বাবা ক্ষেপু মুরাও ছিলেন ডাক-রানার। তিনি দস্যু আর বন্যপ্রাণীর মোকাবিলা করে ডাক পৌঁছে দিতেন, যা আজও স্থানীয় গ্রামবাসীরা গল্পের মতো শুনিয়ে থাকেন। আজ বয়সের ভারে ক্লান্ত হলেও কালিপদকে মাঝে মাঝে সাহায্য করেন তাঁর দুই ছেলে শম্ভু ও কার্তিক। তাঁরা আর দৌড়ান না, বরং সাইকেলে করে পৌঁছে দেন ডাক।
আগেকার দিনে ডাক-রানারের ঝুলিতে থাকত মানুষের ব্যক্তিগত চিঠি। এখন সেসব জায়গা নিয়েছে স্কুলের বই, জামাকাপড়, জুতো, এমনকি ব্যাংক কার্ডও। তবে নিয়ম মেনে ডাক-রানাররা জানেন না ঝুলির ভেতরে কী আছে। কালিপদ মুরা বলেন—“আমি শুধু ব্যাগ পৌঁছে দিই, ভেতরে কী আছে জানার অধিকার আমাদের নেই।”
২০২১ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা অনির্বাণ দত্ত তৈরি করেন ডকুমেন্টারি The Last Run। ৩৭ মিনিটের এই ছবিতে ধরা পড়েছে কালিপদ মুরার একাকিত্ব, সংগ্রাম ও প্রতিদিনের দৌড়। দত্ত বলেন, “আমি ডাক ইতিহাসে খুব আগ্রহী ছিলাম। খুঁজতে খুঁজতেই কালিপদবাবুকে পাই। তাঁর নীরবতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।” ছবিতে দেখা যায়—কাঠের খাটে বসে বিড়ি খাচ্ছেন কালিপদ, তারপর খাকি পোশাক পরে ঝুলি কাঁধে বেরিয়ে পড়ছেন দৈনন্দিন পথে।
ডাক-হরকারাদের ইতিহাস ভারতে প্রায় ১২শ শতক থেকে। মানুষ থেকে মানুষে হাত বদল হয়ে পৌঁছে যেত বার্তা। লাল মাটির পথ, অরণ্যের ভয়, পাহাড়ের উঁচু-নিচু রাস্তা পেরিয়েও তারা হয়ে উঠত জীবন্ত সংযোগ সেতু। আজ মোবাইলের যুগে সেই ইতিহাস প্রায় হারিয়ে গেলেও কালিপদ মুরার দৌড় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সংযোগ শুধু যন্ত্রের কাজ নয়, এটি মানুষের হৃদয়ের বন্ধন।
আজকে কালিপদ মুরা হয়তো দেশের শেষ দৌড়বিদদের একজন। হয়তো একদিন তাঁকে ইতিহাসে লেখা হবে “শেষ ডাক-রানার” হিসেবে। কিন্তু অযোধ্যা পাহাড়ের গ্রামবাসীদের কাছে তিনি রয়ে যাবেন খবরের বাহক, আশার আলো আর প্রাণের মানুষ। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার প্রতিধ্বনি— “রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতেরানার চলেছে খবরের বােঝা হাতে,রানার চলেছে রানার!রাত্রির পথে পথে চলে কোনাে নিষেধ জানে না মানারদিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।”