পুঁথি-নামাবলি পরে, আগে আধার-ভোটার কার্ড! ভিনরাজ্যে ‘বাঙালি হেনস্তা’য় সাবধানী পুরোহিতরা
প্রতিদিন | ২৮ আগস্ট ২০২৫
শ্রীকান্ত পাত্র, ঘাটাল: ভিনরাজ্য থেকে দুর্গাপুজো করার ডাক এসেছে। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে বাঙালি হেনস্তার অভিযোগ খবর আসছে, তাতে পুজো করতে যেতে এবার বাড়তি সতর্কতা ঘাটালের পুরোহিত মহলে। পুঁথি আর নামাবলি গোছানো হবে পরে, আগে আধার ও ভোটার কার্ড ব্যাগে ভরতে ব্যস্ত তাঁরা। সাবধানের তো মার নেই! কেউ কেউ আবার দুই কপি করে জেরক্সও করেছেন। মন্ত্র উচ্চারণ একটু এদিক-ওদিক হলেও দেবী দুর্গা ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু ভিন রাজ্যে পুজো করতে গিয়ে পরিচয়পত্র দেখাতে না পারলে ঝামেলার একশেষ! অনেকে তো সেই ভয়ে ভিনরাজ্যে পুজো করতে যাওয়ার বরাতই বাতিল করেছেন। যে ক’জন যাচ্ছেন মুম্বই, রাজস্থানের মতো রাজ্যে, তাঁরা কতটা ভয়ে ভয়ে আছেন, ঘাটাল মহকুমার পুরোহিত পরিবারগুলিতে ঢুঁ মারলেই স্পষ্ট।
এতদিন ভিনরাজ্যে পুজো করতে গেলে পুঁথিপত্তর আর নামাবলি নিয়েই পাড়ি দিতেন পুরোহিতরা। কিন্তু এবার আধার আর ভোটার কার্ড মাস্ট। কারণ, তা না দেখাতে পারলে পড়তে হতে পারে বিপাকে। বিজেপি শাসিত রাজ্যে যেতে হতে পারে থানা বা ক্যাম্পেও। ভিনরাজ্যে পুজো করতে যাচ্ছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের দাসপুরের ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা। সেখানে পুলিশের হয়রানি এড়াতে তাই পুরোহিতরা ‘যক্ষের ধনে’র মতো এবার নিয়ে যাচ্ছেন আধার আর ভোটার কার্ড।
পুলিশি হয়রানি জানা সত্ত্বেও কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই সেই পুরোহিতরা রওনা দিচ্ছেন মুম্বই, দিল্লি, গুজরাট, রাজস্থানের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যে। মূলত, মোটা অঙ্কের রোজগারের আশা থাকলে এই ঝুঁকি বলে জানাচ্ছেন পুরোহিতরা। তাঁদের যুক্তি, ঝুঁকি এড়াতে ঘরে বসে থাকলে এই রোজগার হাতছাড়া হতে পারে। তাই অনেক আগে থেকেই দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট বুক করে ফেলেছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, দাসপুর, চন্দ্রকোনার বহু ব্রাহ্মণ পুরোহিত। এমনটাই জানাচ্ছেন সনাতন ব্রাহ্মণ ট্রাস্টের ঘাটাল ব্লক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জগদীশ মিশ্র। তিনি বলছেন, ”সংবাদমাধ্যমের দৌলতে ভিনরাজ্যে বাংলাভাষীদের হয়রানির খবর পাচ্ছি। ফলে ভয় তো একটু লাগছেই। কিন্তু ভয়ে করে বা হয়রানির ভয়ে ঘরে বসে থাকলে তো মোটা রোজগার হাতছাড়া হয়ে যাবে।”
গণেশ পুজো থেকে শুরু করে বিশ্বকর্মা পুজোতেও ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ভিনরাজ্যে যান পুজো করতে। এছাড়া দুর্গাপুজো তো আছেই। ঘরে ফেরার সময় মোটা অঙ্কের রোজগার করতে পারেন তাঁরা। এ তো সেই আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। এবছর যেহেতু একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে, তাই তাঁদের আধার, ভোটার কার্ড-সহ অন্যান্য প্রামান্য নথি নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। তাছাড়া যাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে পুরোহিতরা পুজো করতে যাচ্ছেন তাঁরাও তো তাঁদের একজন বড় সাক্ষী। অনেকেই তো রওনা দিয়েছেন ভিনরাজ্যে। দাসপুরের ডিহিবলিহারপুর গ্রামের বাসিন্দা ভূতনাথ রায় বলছেন, “আমি কয়েক বছর ধরে মুম্বই শহরে পুজো করতে যাচ্ছি। কোনও সমস্যা হয়নি। এবছর একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে বাংলাভাষীদের নিয়ে। তাই বলে আমি মুম্বই যাব না তা নয়, তবে পুঁথিপত্তর, নামাবলি, পুজোর আসবাবপত্রের সঙ্গে ভোটার, আধার কার্ডও নিয়ে যাচ্ছি যাতে অযথা হয়রানির শিকার হতে না হয়।” একই কথা জানিয়েছেন চন্দ্রকোনার নাড়ুয়া গ্রামের শংকর চক্রবর্তী। তিনি ইতিমধ্যেই মুম্বই রওনা দিয়েছেন। ফিরবেন সেই দুর্গাপুজোর পর। সঙ্গে নিয়েছেন নামাবলি, পুঁথিপত্তরের সঙ্গে আধার, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ডও।
সনাতন ব্রাহ্মণ ট্রাস্টের দাসপুর দুই নম্বর ব্লকের সম্পাদক প্রবীর চক্রবর্তী ও দাসপুর এক নম্বর ব্লকের সভাপতি দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, “পুলিশি হয়রানি কার ভালো লাগে বলুন তো? সব জেনেশুনে পুরোহিতদের ভিন রাজ্যে যেতে হচ্ছে শুধু রোজগারের আশায়। গণেশ পুজো থেকে দুর্গাপুজো পর্যন্ত একজন পুরোহিতের কয়েক হাজার টাকা রোজগার হয়ে যায়। তাছাড়া উদ্যোক্তারা যাতায়াতের জন্য ট্রেনের ভাড়াও দিয়ে দেন। তাই আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে সবাইকে বলে দিয়েছি সঙ্গে যেন অবশ্যই পরিচয়পত্র থাকে তাঁদের। অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে আধার, ভোটার কার্ড-সহ যাবতীয় নথি।”