তুখোড় ভূমিকা ছিল অজিত ডোভালের! 'গুপ্তচর রানি'কে শায়েস্তা করে করেছিলেন বাজিমাত
আজকাল | ২৮ আগস্ট ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: তিনি আইপিএস। সাঁইত্রিশ বছরের মধ্যে উর্দি গায়ে চাপিয়েছিলেন মাত্র সাত বছর। বাকি তিরিশ বছর কখনও কুর্তা পাজামা, কখনও লুঙ্গি পাঞ্জাবি, কখনও অন্য কোনও পোশাকে মিশে গিয়েছিলেন জনসমুদ্রে। ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবে ভারত ও বিদেশে গোপন মিশন চালিয়েছেন যুগের পর যুগ। ক্রমশ অজিত কুমার ডোভাল হয়ে উঠেছেন ভারতের একমাত্র সুপার স্পাই।
অজিত ডোভালের নানা কর্মকাণ্ড আজ যেন রূপকথা! পাকিস্তান বা চীনে তাঁর মিশন বেশ রোমহর্ষক। কিন্তু, তাঁর নৈপুন্যতায় সিকিম ক্রমশ ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। সেকথা অনেকেরই অজানা।
৭০-এর দশকের গোড়ার কথা। সিকিম রাজতন্ত্র তখন চরম সঙ্কটের মুখোমুখি। ঠিক সেই সময়কেই কাজে লাগান অজিত ডোভাল। ভারতের পক্ষে কাজ হাসিল হয় সহজে।
হোপ কুক। তাঁর সঙ্গে সিআইএ-র যোগসূত্র ছিল বলে অভিযোগ। ফলে তিনি ছিলেন প্রভাবশালী। হোপ কুকের সঙ্গে ওয়াশিংটনের খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এমন সময়ে আবার ভারত-মার্কিন সম্পর্কও বেশ টালমাটাল। এদিকে, ভারত-চীন সীমান্তে অবস্থিত সিকিম তখন বিবেচিত ছিল 'বাফার স্টেট' হিসাবে। এই প্রেক্ষিতে সিকিমকে নিজেদের কব্জায় রাখা ছিল ভারতের অন্যতম উদ্দেশ্য। ফলে উদ্দেশ্য সাধনে কাজে লাগানো হয় দুঁদে গোয়েন্দা অজিত ডোভালকে।
১৬৪২ সাল থেকে সিকিম চোগিয়াল রাজবংশের শাসনাধীন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর, সিকিম একটি সুরক্ষিত রাজ্যে পরিণত হয়, যার অর্থ- দিল্লি, সিকিমের প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক বিষয় পরিচালনা করত এবং সেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দেখভাল করত চোগিয়ালরা। এ সবের মধ্যেই প্যালডেন থন্ডুপ নামগিয়াল তাঁর বাবার মৃত্যুর পর চোগিয়াল হন, ফলে ১৯৬৫ সালের পর এই ব্যবস্থার বদল হতে শুরু করে।
থন্ডুপ ভারতে পড়াশোনা করেছিলেন এবং তাঁকে বাস্তববাদী হিসেবে দেখা হত। কুর্সি দখলের দু'বছর আগে, থন্ডুপ মার্কিন প্রভাবশালী মহিলা হোপ কুকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এরপর তাঁদের ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা, প্রেম, তারপর বিয়ে। ফলে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন হোপ কুক। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, কুক হন সিকিমের রানি।
এরপর থেকেই সিকিম প্রশাসন পরিচালনার নীতিগত বিষয়ে হোপ কুকের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এক সময়ে হোপ কুক বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে ভারতের প্রভাবমুক্ত সিকিম গড়ে তোলার বিষয়ে জোর দেন। এই ইস্যুতে বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে মুখও খোলেন তিনি। নিজের স্বামী তথা সিকিমের রাজা প্যালডেন থন্ডুপ নামগিয়ালকেও ভারতের প্রভাবমুক্ত সিকিম গড়ে তুলতে চাপ দেন। অর্থাৎ স্বাধীন সিকিম-ই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
লেখক দেবদত্ত ডি, তাঁর লেখা বই 'অজিত ডোভাল: অন আ মিশন'-এ, লিখেছেন- দিল্লির বিষনজরে পড়েন হোপ কুক। সাউথ ব্লক মনে করত, ওয়াশিংটন কুককে ভারত বিরোধী একজন মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরছে ও প্রশ্রয় দিচ্ছে।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়, যখন ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তখন সিকিমের রানি হোপ কুকের উপস্থিতি আরও বিতর্কিত হয়ে ওঠে। উদ্বেগ বাড়ে দিল্লির। হিমালয়ের পাদদেশে 'বাফার রাষ্ট্র'-র উপর মার্কিন দাপাদাপি ছিলবারতের কাছে দুঃস্বপ্ন, বিশেষ করে যখন চীন উত্তর ও উত্তর--পূর্ব ভারতে আগ্রাসী আচরণ স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
পরিস্থিতি ঘোরাতে তখনই অজিত ডোভাল-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজতন্ত্র নিয়ে সিকিমবাসীর মেজাজ মূল্যায়ন এবং রানির প্রভাব মোকাবিলা করার দায়িত্ব ছিল এই দুঁদে গোয়েন্দার উপর।
ডোভাল স্থানীয়দের মধ্যে মিশে যান, কতা বলেন সিকিমের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ যাচাই করেন। দিল্লির সঙ্গে আম সিকিমবাসীর কথা তুলে ধরেন।
অজিত ডোভালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, সিকিমের জনগণ, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালি জনগণ, চোগিয়াল মার্কিন বংশদ্ভুত রানীর প্রতি ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠছিল।আম আদমির মন থেকে রাজপ্রাসাদের বাসিন্দাদের মন বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছিল। রাজা-রানীকে অভিজাত এবং ভারতবিরোধী হিসেবে দেখা শুরু হয়। এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফলে ক্রমশ দিল্লি নিশ্চিত হয়ে যায় যে, ভারতের সঙ্গে সিকিমের অন্তর্ভুক্তিকরণের এটাই সেরা সময়। কৌশলগতভাবে বিষয়টি সুসম্পন্ন করতে পারলেই সিকিমের জনগণ বিষয়টি ব্যাপকভাবে স্বাগত জানাবে।
১৯৭৩ সালের মধ্যে, সিকিমে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা গণতন্ত্রের দাবিতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মিছিল করে। ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে, হোপ কুক অবশেষে সিকিম ছেড়ে নিউ ইয়র্ক চলে যান, আর কখনও ফিরে আসেননি।
দু'বছর পর ১৯৭৫ সালে, সিকিম বিধানসভা রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পক্ষে বিপুল ভোটে ভোট দেয়। এই গণভোট নিশ্চিত করে যে, ৯৭ শতাংশেরও বেশি মানুষ ভারতে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে। উদ্দেশ্য সাধনে দিল্লি দ্রুত অগ্রসর হয় এবং সিকিম ভারতের ২২তম রাজ্য হয়ে ওঠে।