শ্রীনগর: ‘জয় মাতা দি’... ধ্বনিতে কান পাতা যেত না যে রাস্তায়, সেখানে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। প্রকৃতির রুদ্ররোষে মুত্যুপুরী বৈষ্ণোদেবী! মঙ্গলবার ভয়াবহ ধসে সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। সেই সংখ্যা বেড়ে এখন ৩৬। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আরও ২৩ জনকে। ঘটনাস্থলে এখনও আটকে বহু পুণ্যার্থী। রাতভর উদ্ধারকাজ চলেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে কাদা মাখামাখি অবস্থায় বেরিয়ে এসেছে একের পর এক মৃতদেহ। লাফিয়ে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। শুধু এই তীর্থক্ষেত্র নয়, নাগাড়ে বৃষ্টিতে আতঙ্কে কাঁপছে গোটা জম্মু। বাকি রাজ্যে আরও ৪-৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। উত্তর ভারতের একাধিক রাজ্যে একই পরিস্থিতি। বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ। দুই রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।
অর্ধকুমারীর ইন্দ্রপ্রস্থ ভোজনালয়। বৈষ্ণোদেবী যাত্রা যাঁরা করেছেন, প্রত্যেকেই এক নামে চেনেন। শ্রী মাতা বৈষ্ণোদেবী শ্রাইন বোর্ডের এই ভোজনালয়ের সামনের রাস্তাটা এখন পাথর-কাদার স্তূপ। পাশের ছাউনির লোহার বিম, বসার বেঞ্চগুলো দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। কাদায় অর্ধেক ডুবে থাকা দেহগুলো এখনও চোখ বুজলেই ভেসে উঠছে চোখের সামনে। গত ২৪ ঘণ্টা ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো সঙ্গীদের খুঁজে চলেছেন অমৃতসর থেকে আসা সানি গিরি। মোট ছ’জনের দল ছিল তাঁদের। ক’জন বেঁচে রয়েছেন? কোন হাসপাতালে খোঁজ নিতে হবে? কিছুই জানেন না সানি। শুধু তিনি নন, পাগলের মতো অবস্থা বারাণসী থেকে আসা মনোজ বিস্ত, সতীশ চৌধুরী, বিহারের রানিকুমারীর মতো অসংখ্য মানুষের। জীবিত অবস্থায় ফিরলেও কথা বলার মতো অবস্থায় নেই অনেকে। এঁদের কারও চোখের সামনে ভেসে গিয়েছেন স্বামী-সন্তান, কেউ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দেখেছেন প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু।
বুধবার এই দুর্ঘটনা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। আহতরা দ্রুত আরোগ্য লাভ করুক। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছে।’ উপত্যকার বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন ওমর আবদুল্লা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। উদ্ধারকাজের অগ্রগতি জানিয়েছি। সবরকমভাবে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। ভূস্বর্গের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি নিয়ে শোকপ্রকাশ করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক্স হ্যান্ডলে তিনি লেখেন, ‘মা বৈষ্ণোদেবীর কাছে প্রার্থনা করছি আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক।’ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
মঙ্গলবার থেকে একযোগে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে সেনা, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ও রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দল। প্রশাসনের দাবি, ইতিমধ্যেই প্রায় ৩৫০০ তীর্থযাত্রীকে নিরাপদে সরানো হয়েছে। ব্যবহার করা হচ্ছে সেনার হেলিকপ্টার। তবে উদ্ধারকাজ শেষ হয়নি। মনে করা হচ্ছে এখনও অনেকে ধ্বংসস্তূপে আটকে রয়েছেন। তাই মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। বিপর্যয়ের ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য যাত্রা স্থগিত রেখেছে বৈষ্ণোদেবী মন্দির কর্তৃপক্ষ। বাতিল করা হয়েছে জম্মু-কাটরা রুটের ২২টি ট্রেন। তাতে সমস্যা আরও বেড়েছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনার বীভৎসতা ভুলতে পারছেন না। পাঞ্জাবের বাসিন্দা কিরণের কথায়, ‘গর্ভ জুন গুফা মন্দিরের কাছে আচমকা পাহাড় থেকে পাথর পড়তে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে ধসে যায় রাস্তা। তারাকোট মার্গ দিয়ে চারঘণ্টা ঘুরে কোনওমতে প্রাণ হাতে ফিরেছি।’
আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় জম্মুতে ২৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এটা গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বাধিক। উধমপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় ৬২৯.৪ মিমি বৃষ্টি হয়েছে, যা সর্বকালীন রেকর্ড।