নিজস্ব প্রতিনিধি, নন্দকুমার: ডাক্তারি পড়াশোনা ছাড়াই ডাক্তার পরিচয়ে করছেন চিকিৎসা, অপারেশন। অনুমোদন ছাড়াই বাড়িতে নার্সিংহোম। অপারেশনের পর তিনদিন রেখে রোগীদের ডিসচার্জ। নন্দকুমার ব্লকে বাবলপুর সামন্তপাড়ার ভুয়ো চিকিৎসা কারবারের পর্দাফাঁস হতেই তড়িঘড়ি রিপোর্ট চাইলেন জেলাশাসক। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজী ওই ঘটনায় মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের থেকে রিপোর্ট চেয়েছেন। ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্যদপ্তরে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। জেলাশাসকের অফিস থেকে সাত কিলোমিটার এবং তমলুক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবৈজ্ঞানিক কায়দায় চিকিৎসা চলছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই একেবারে হইচই পড়ে গিয়েছে। তড়িঘড়ি রিপোর্ট চেয়েছেন জেলাশাসক।
মেচেদা, কোলাঘাট, পাঁশকুড়া, হাওড়া, দাসপুর ও হলদিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় এজেন্ট নিয়োগ করেছেন সামন্তপাড়ার ভুয়ো ডাক্তাররা। রোগী পিছু ২০০টাকা কমিশন। মেচেদা থেকে অনেকে গাড়ি ভাড়া করে রোগী নিয়ে সরাসরি চেম্বারে আসে। রোগী আনার জন্য ওই গাড়িচালকের কমিশন ২০০ টাকা। সামন্তপাড়ার প্রায় ২০টি পরিবার অর্শ, বলি ও ভগন্দরের চিকিৎসা করছে। তাঁদের মধ্যে আবার কয়েকজন তৃণমূল ও বিজেপির নেতাও আছেন। এক-একটি পরিবার বাবা-ছেলে, স্বামী-স্ত্রী নামের আগে ডাক্তার লিখে ফেক্স ছাপিয়ে, বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। অথচ, তাঁদের কেউ এইট পাশ কেউ বা কোনওরকমে মাধ্যমিক উতরেছেন।
সামন্তপাড়ার ব্যোমকেশ সামন্ত, নারায়ণচন্দ্র সামন্ত, সুবলচন্দ্র সামন্ত, খোকন জানা সহ আরও অনেকে ডাক্তারি পাশই করেননি। কিন্তু, প্রত্যেকে নামের আগে ডাক্তার লিখে চুটিয়ে চেম্বার করছেন। ব্যোমকেশবাবুর দুই ছেলে, স্ত্রীও একইভাবে ডাক্তার। নারায়ণবাবুর ছেলে শুভদীপও তাই। সবাই একযোগের নামের আগে ডাক্তার লিখে রেখেছেন। শুধু চেম্বার নয়, বেশ কয়েকজনের বাড়িতে নার্সিংহোমো খোলা আছে। সেখানে অপারেশনের পর রোগীকে ভর্তি রাখা হয়।
স্বাস্থ্যদপ্তরের অনুমোদন, ডাক্তারি বিদ্যার ধারেকাছে না গিয়েও দিব্যি বেআইনিভাবে এই কারবার চলছে। অনেক মহিলা রোগী পাইলসের সমস্যা থাকায় পুরুষ ডাক্তারদের দেখাতে চান না। তাঁদের কাছে মুসকিল আসান ব্যোমকেশবাবুর স্ত্রী শেফালিদেবী। হেঁসেল সামলে শেফালিদেবী বাড়িতে অপারেশন করতে ছুরি-কাঁচি ধরেন। রান্না ঘরে খুন্তি নাড়তে নাড়তেই দৌড়ে গিয়ে ওটিতে হাজির হয়ে যাচ্ছেন। সামন্তপাড়া আস্ত ডাক্তারপাড়া নামে পরিচিত। যদিও প্রত্যেকেই স্বঘোষিত ডাক্তার। প্রশাসনের নাকের ডগায় কীভাবে এতদিন ধরে এই বেআইনি ‘চিকিৎসা কারবার’ চলছে তা নিয়ে নানামহলে প্রশ্ন ওঠছে।
নারায়ণবাবু এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা। চারবারের পঞ্চায়েত সদস্য ছিলেন। ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে হেরে যান। নিজের বিলাসবহুল গাড়ির সামনে ও পিছনে ডাক্তারের লোগো। ব্যোমকেশবাবুও অঞ্চল তৃণমূলের ক্যাশিয়ার। যদিও তাঁর এক ছেলে শিবশঙ্করবাবু বিজেপির পঞ্চায়েত সদস্য। রাজনৈতিকভাবেও ভুয়ো ডাক্তাররা প্রভাবশালী। ফিসচুলার সমস্যায় ভোগা রোগীরা এদের কাছে স্বয়ং লক্ষ্মী। কারণ, ১৫-২০ হাজার টাকার প্যাকেজ। অবৈজ্ঞানিক উপায়ে অপারেশনের ফলে অনেকেই নানা জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগছেন। এধরনের ঘটনা থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
এনিয়ে ব্যোমবেশবাবু বলেন, আমরা কোনও ডিগ্রি কিংবা কোর্স করিনি। তবে, বাপ-ঠাকুদার পেশায় ছোট থেকে যুক্ত হয়ে অভিজ্ঞ হয়েছি। আমাদের ছেলেরাও একইভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। নারায়ণবাবু বলেন, দূর দূরান্ত থেকে রোগী আসে। এখানে চিকিৎসায় সাফল্যের হার বেশি। সেজন্য সকাল থেকে অর্শ, বলি, ভগন্দর ব্যধিতে ভোগা রোগীর ভিড় থাকে। আমি দুই মেদিনীপুর ও হাওড়ার একাধিক জায়গায় চেম্বার করি।
জেলাশাসক বলেন, গোটা বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে একটি রিপোর্ট দিতে বলেছি।