• পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য নয়া প্রকল্প ‘নতুন বেকার ভাতা’! নির্দিষ্ট অংশের বেকারদের কি এই সহায়তা দিতে পারে রাজ্য
    আনন্দবাজার | ২৭ আগস্ট ২০২৫
  • ভিন্‌রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের উপর আক্রমণের আবহে নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। পোশাকি নাম ‘শ্রমশ্রী’। যেখানে বলা হয়েছে, বাইরে থেকে পরিযায়ী শ্রমিকেরা রাজ্যে ফিরতে চাইলে তাদের এককালীন মাসে ৫,০০০ টাকা দেবে রাজ্য। নতুন কাজ না-পাওয়া পর্যন্ত ১২ মাস অবধি প্রতি মাসে ৫,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে তাঁদের। যাকে অনেকে ‘নতুন বেকার ভাতা’ হিসাবে অভিহিত করছেন।

    প্রসঙ্গত, রাজ্যে ইতিমধ্যেই ‘যুবশ্রী’ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। যা আসলে বেকারদের ভাতা দেওয়ারই প্রকল্প। রাজ্যের ‘এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক’-এ নাম নথিভুক্ত করলে সরকার নথিপত্র খতিয়ে দেখে ওই ভাতা দেয়। মাসে ১,৫০০ টাকা করে পাওয়া যায় ‘যুবশ্রী’তে। তবে ‘শ্রমশ্রী’ তা নয়। প্রসঙ্গত, ‘শ্রমশ্রী’র যে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে রাজ্য সরকার, সেখানেও ‘জবলেস’, ‘আনএমপ্লয়মেন্ট’ শব্দগুলি লেখা রয়েছে। যার অর্থ ‘বেকার’ বা ‘কর্মহীন’। ফলে রাজ্য সরকার একে আনুষ্ঠানিক ভাবে বেকার ভাতা না-বললেও বিষয়টি তেমনই বলে মনে করছেন অনেকে।

    উল্লেখ্য, দেশের প্রায় সব রাজ্যেই বিভিন্ন নামে বেকার ভাতা রয়েছে। অধিকাংশ রাজ্যই মাসে ১,০০০-১,৫০০ টাকা ভাতা দেয় বেকারদের। যেমন যুবশ্রী প্রকল্পে দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে রাজস্থান। মরুরাজ্যে পুরুষ বেকারদের মাসে ‘বেরোজগারি ভাতা’ দেওয়া হয় ৪,০০০ টাকা। বেকার মহিলারা পান ৪,৫০০ টাকা।

    রাজ্য শ্রম দফতর সূত্রের খবর, ‘শ্রমশ্রী’ পোর্টাল তৈরির কাজ প্রায় হয়ে এসেছে। খুব শীঘ্রই তা শুরু হয়ে যাবে। তার পরে সেই পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করে রাজ্যে ফিরলে ‘ভাতা’ পাবেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। এর মধ্যেই সরকারি স্তরে ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনও ভাবেই যাতে ‘শ্রমশ্রী’তে ভুয়ো পরিযায়ীরা প্রবেশ করতে না-পারে।

    পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কি এ ভাবে ভাতা রাজ্য সরকার দিতে পারে? এই প্রশ্নে শাসক-বিরোধী সব শিবিরের আইনজীবীরাই প্রায় একমত। তাঁদের বক্তব্য, সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্প হিসাবে রাজ্য এই ভাতা দিতেই পারে। তৃণমূল সাংসদ তথা আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সমাজের নির্দিষ্ট অংশের জন্য যে কোনও সরকারই সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্প ঘোষণা করতে পারে। তাতে কোনও বাধা নেই।’’ বিজেপির আইনজীবী নেতা তথা মুখপাত্র তরুণজ্যোতি তিওয়ারির কথায়, ‘‘সরকার প্রকল্প ঘোষণা করতেই পারে। তবে কেন করছে তার ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। না হলে আদালতে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।’’ একই বক্তব্য ‘বামপন্থী’ আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়েরও। যদিও গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে রাজ্যের তরফে বিশদে প্রকল্পের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। নবান্নের বক্তব্য, রাতারাতি কেউ কর্মহীন হয়ে পড়লে রাজ্য সরকারের কর্তব্য তাঁর পাশে দাঁড়ানো। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে প্রকল্পের ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

    বিরোধী শিবিরের তরুণজ্যোতি-সব্যসাচীদের বক্তব্য, এই প্রকল্প আসলে বেকার ভাতাই। নতুন মোড়কে তা ঘোষণা করেছে রাজ্য। যদিও রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান তথা তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম একে বেকার ভাতা বলতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘এটা পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি রাজ্যের সম্মান প্রদর্শন।’’

    তবে মাসে এই ৫,০০০ টাকা ভাতা নেওয়ার জন্য কত পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যে ফিরবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে প্রশাসনের অনেকেরই। শ্রম দফতরের এক পদস্থ আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘কেমন সাড়া পাওয়া যাবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ নিয়ে আমরা অনেকেই সন্দিহান।’’ তার মূল কারণ অর্থের পরিমাণ। বাইরের রাজ্যে যাঁরা কাজ করতে যান, তাঁরা অনেকেই মাসে প্রস্তাবিত ভাতার অর্থের কয়েক গুণ বেশি রোজগার করেন বলে তাঁরা নিজেরাই বিভিন্ন পরিসরে জানিয়েছেন। বাস্তবেও তেমনই তথ্য জানা যাচ্ছে। সেই সূত্রেই প্রশ্ন, তাঁরা তুলনায় কম এই পরিমাণ টাকায় কাজ না-পাওয়ার অনিশ্চয়তা নিয়ে পশ্চিমবাংলায় ফিরবেন কেন? সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। যেখানে কেরল, তামিলনাড়ু, উত্তরাখণ্ডে কাজ করতে যাওয়া মালদহ, মুর্শিদাবাদের শ্রমিকেরা প্রশ্ন তুলছেন, কেন তাঁরা এই মাসিক ভাতার ভরসায় রাজ্যে ফিরবেন? তৃণমূল যদিও এই সমস্ত ভিডিয়োকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেই অভিহিত করেছে।

    নতুন শ্রমশ্রী প্রকল্পকে তৃণমূল যখন তাদের সরকারের ‘মানবিক মুখ’ হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে, তখন বিরোধীরা পাল্টা প্রশ্ন তুলছে, কেন এত শ্রমিককে রাজ্যের বাইরে যেতে হচ্ছে? বিরোধীদের ব্যাখ্যা, রাজ্যে কর্মসংস্থানের আকাল বলেই বাংলা ছেড়ে রাজ্যের মানুষকে ভিন্‌রাজ্যে কাজের সন্ধানে যেতে হচ্ছে। ‌পাল্টা তৃণমূলের বক্তব্য, মমতার আমলেই যে পরিযায়ী শ্রমিক তৈরি হয়েছে তা নয়। যুগ যুগ ধরেই তা চলছে। তৃণমূলের এ-ও বক্তব্য, বাংলার যেমন ২২ লক্ষ শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান, তেমনই বাইরের রাজ্যেরও দেড় কোটি মানুষ এই রাজ্যে করেকম্মে খান।

    রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, রাজ্য সরকারের ঘোষণায় স্পষ্ট, আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখেই এই প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ, শ্রমশ্রীতে এক বছরের কথাই বলা হয়েছে। এই পর্বের মধ্যেই বিধানসভা ভোট মিটে যাওয়ার কথা। দ্বিতীয়ত, রাজ্য চাইছে ভোটের আগে পৃথক একটি উপভোক্তা গোষ্ঠী (বেনিফিশিয়ারি গ্রুপ) তৈরি করতে। কিন্তু সেই প্রয়াস কতটা বাস্তবায়িত হবে, সে দিকেই তাকিয়ে গোটা শ্রম দফতর। তাকিয়ে রাজ্য সরকারও।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)