• মোদীর ‘চোর’ মন্তব্যে তীব্র ক্ষোভ, বর্ধমানের সভা থেকে পাল্টা দিলেন মমতা
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৭ আগস্ট ২০২৫
  • প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত সপ্তাহে কলকাতায় মেট্রো প্রকল্পের উদ্বোধনে এসে একাধিকবার রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে আক্রমণ করে ‘চোর’ শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন। মঙ্গলবার বর্ধমানের প্রশাসনিক সভা থেকে সেই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘কিন্তু বাংলাকে চোর বলার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? বাংলার মানুষকে অপমান করার সাহস কোথা থেকে আসে?’ তিনি বলেন, বাংলাকে ওরা সহ্য করতে পারে না। ক্ষমতায় থেকে বাংলাকে ভাতে মারার চেষ্টা করছে। এভাবেই মঙ্গলবার দুপুরে শহর থেকে নাম না করে বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    প্রসঙ্গত, এদিন পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের প্রশাসনিক সভা ছিল বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুলের মাঠে। বেলা পৌনে দুটো নাগাদ কলকাতা থেকে সড়ক পথে সরাররি তিনি বর্ধমানে আসেন। মঞ্চে উঠেই সরকারি প্রকল্পের শিল্যানাস, উদ্বোধন ও পরিষেবা তুলে দেবার পর বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। প্রায় ৫০ মিনিটের বেশি সময় ধরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিংহভাগ সময় বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের নানা বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন। বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে অত্যাচার ও নির্যাতনের কথা তুলে ধরে ক্ষোভ উগরে দেন।

    মুখ্যমন্ত্রী এদিন শুরুতেই আবাস যোজনা, সবুজ সাথী, চোখের আলো, কৃষাণ ক্রেডিট, রূপশ্রী, মৎস্যজীবীদের সহায়তা সহ একাধিক প্রকল্পের সুবিধা প্রদান করেন। আদিবাসীদের ধামসা মাদল দেওয়া, তাঁতিদের সাহায্য, মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে সহায়তা সবই প্রদান করেন। সেই সঙ্গে একাধিক নতুন প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধন করেন। মঞ্চে রাজ্যের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, দুই জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকরা হাজির ছিলেন।

    এদিন শুধুমাত্র এই দুই জেলাই নয় ১৪টি জেলার বিভিন্ন প্রকল্পের ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি বলেন, আগে পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান একটাই জেলা ছিল। দুরত্বের জন্য দুটি জেলায় ভাগ করা হয়েছে। দুই জেলার ধর্মীয় স্থানের সংস্কার, সংস্কৃতির কথা তুলে ধরেন। তারপর এই দুই জেলার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তাঘাট নিয়ে একাধিক প্রকল্পের কাজের কথাও উল্লেখ করেন। এই মঞ্চ থেকেই বর্ধমানের সদরঘাটে শিল্প সেতুর শিলান্যাস করেন।

    এইসব প্রকল্পের ঘোষণার পর মুখ্যমন্ত্রী বার বার কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ করেন। মমতা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আটকে দেওয়ার অভিযোগ তুলে বলেন, তিন বছর ধরে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওরা বাংলাকে ভাতে মারতে চাইছে। তবুও ভোট এলেই পরিযায়ী পাখির মতো এখানে চলে আসছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘জিএসটিতে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার রাজস্বের ক্ষতি হয়েছে। তাও আমরা মেনে নিয়েছি। বাংলাকে ওরা দেখতে পারে না।’

    তাঁর বক্তব্য, ‘কেন্দ্র থেকে ১৮৬টি প্রতিনিধিদল বাংলায় এসেছে, প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। তবুও বাংলাকে শূন্য দেখানো হচ্ছে। উন্নয়নের টাকা আটকে দিয়ে বাংলার মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা কি মেনে নেওয়া যায়?’ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, রাজ্যের কোষাগার থেকেই প্রকল্পের অর্থ মেটাচ্ছে সরকার, যাতে মানুষের কাজ আটকে না যায়।

    রাজনৈতিক মহলের মতে, মমতার এই বক্তব্য শুধু কেন্দ্র-বিরোধী সুরকে আরও চড়িয়েছে তা-ই নয়, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য রাজনীতিতে ‘অপমান’ ও ‘বঞ্চনা’-র ইস্যু তৃণমূলের বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে চলেছে। অন্যদিকে, বিজেপি শিবিরের পাল্টা তাদের দাবি, কেন্দ্রের প্রকল্পের টাকা গরিবদের স্বার্থে কাজে না লাগিয়ে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তদন্ত অব্যাহত থাকবে।

    প্রধানমন্ত্রীর ঘন ঘন সফর নিয়েও এদিন কটাক্ষ করেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘ইলেকশন এলেই পরিযায়ী শ্রমিকের মতো বাংলায় চলে আসেন। আসুন, আমি চাই আপনি রোজ আসুন। বিমান ফ্রি, হেলিকপ্টার ফ্রি, রাস্তাও ফ্রি— সব পাচ্ছেন ফ্রিতে। কিন্তু বাংলাকে চোর বললে মানুষ চুপ করে বসে থাকবে না।’

    এদিন নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ভোট এলেই এনআরসি করতে হবে? নতুন করে নাম কাটতে হবে?’ এরপরই মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন কমিশনকে নিশানা করে বলেন, ‘ইলেকশন কমিশনকে আমি প্রণাম জানাই, সালাম জানাই—কিন্তু বিজেপির ললিপপ হবেন না। তা হলে কিন্তু বাংলার মানুষ ক্ষমা করবে না।’

    তবে বর্ধমানের সভা থেকে মমতা আরও একবার কেন্দ্রের শাসকদল ও মোদী সরকারকে স্পষ্ট করে দেন যে, উন্নয়ন ও সম্মানের প্রশ্নে বাংলার মানুষকে অপমান করা হলে তৃণমূল সরকার সরব হবে। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমি এই ধরনের মন্তব্য আশা করিনি। আমি যেমন ওনার চেয়ারকে সম্মান করি, ওনারও উচিত আমাদের চেয়ারগুলোকে সম্মান করা। বাংলার মানুষ চোর নয়, বাংলার মানুষ লড়াই করতে জানে।’

    প্রসঙ্গ পাল্টে মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির বিরুদ্ধে কটাক্ষ করে বলেন, ‘বাংলায় নাকি সবাই “বাংলাদেশি” থাকে। আমাদের ভাষা এক তো আমরা কী করব? আমাকে গালাগালি দিন, বাংলাকে অপমান করবেন না। এনআরসি দেখিয়ে বা অন্যভাবে ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। এশিয়াতে দু’নম্বরে আছে বাংলা ভাষা। মগজে মরুভূমি আছে বলে বুঝতে পারছেন না। বাংলার অবদান, ইতিহাস ভুলে গেলে হবে না। যেদিন ক্ষমতায় থাকবেন না সে দিন কী হবে?’

    তবে রাজনৈতিক মহলের মতে, মমতার এই মন্তব্য প্রমাণ করছে যে, আগামী দিনে রাজ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ আরও বাড়বে। আর কেন্দ্র বনাম রাজ্যের সংঘাত আরও স্পষ্ট হবে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)