• প্ল্যাটফর্মেই মৃত্যু, স্ত্রীর দেহ কাঁধে তুলে বরাভূম স্টেশন ছাড়লেন বৃদ্ধ
    বর্তমান | ২৭ আগস্ট ২০২৫
  • পিনাকী ধোলে, পুরুলিয়া: সপ্তাহের প্রথম দিনের ব্যস্ত সকাল। পুরুলিয়ার বরাভূম স্টেশনে ট্রেন ধরার দৌড়ঝাঁপ সবার। প্ল্যাটফর্মে কেউ বসে। কেউ দাঁড়িয়ে। ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা ঘর পেরিয়েছে। স্টেশনে ঢুকল গোমো এক্সপ্রেস। যাত্রীদের ট্রেনে ওঠার তাড়া। ভিড় এড়িয়ে একটি কামরা থেকে অচৈতন্য স্ত্রীকে চ্যাংদোলা করে কোনওরকমে নামালেন শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ। বেঞ্চে বসানোর ক্ষমতা ছিল না। পড়ে রইলেন প্ল্যাটফর্মেই। পাশে বসে বৃদ্ধ স্বামী। কিছুক্ষণ হাত-পা নাড়তে নাড়তে নিথর হয়ে গেলেন বৃদ্ধা। ডুকরে কেঁদে উঠছেন বৃদ্ধ। পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন ব্যস্ত সকলেই! দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচঘণ্টা বসে থাকার পর স্ত্রীর কাঁধে তুলে প্ল্যাটফর্ম ছাড়লেন বৃদ্ধ। সোমবার সকালে বরাভূম স্টেশনে এমন অমানবিক ঘটনা ফের মনে করিয়ে দিল বিবেকহীন সমাজের নগ্ন রূপকে! অভিযোগ, বৃদ্ধার মৃত্যুর পরও এগিয়ে আসেননি স্টেশনে কর্তব্যরত রেলপুলিস ও আধিকারিকরা।   

    প্ল্যাটফর্মে নেমে গোটা দৃশ্যটি মোবাইল বন্দি করেছিলেন চন্দন শর্মা নামে এক যুবক। সেটাই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করতেই মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল। কেঁপে যায় গোটা নেট দুনিয়া। রেলের বিরুদ্ধে সমালোচনায় সরব হন নেট নাগরিকদের একটা বড় অংশ। ততক্ষণে, বর্তমান সমাজের বিরুদ্ধে একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন ওই অসহায় বৃদ্ধ।   

    রেল পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃত বৃদ্ধার স্বামীর মনোজ কর্মকার। পুরুলিয়ার গোশালা বস্তিতে থাকেন। স্ত্রী শান্তা কর্মকারকে নিয়ে প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করে পেট চালান। সোমবার সকালে ঝাড়খণ্ডের কেন্দ্রা স্টেশন থেকে গোমো এক্সপ্রেস ধরে পুরুলিয়া ফিরছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘ট্রেনের মধ্যেই স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে বরাভূম স্টেশনে নেমে পড়ি। কেউই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি।’ অসুস্থ স্ত্রীকে স্টেশনে নামানোর কিছু পরেই মৃত্যু হয়। ওই অবস্থাতেই কয়েক ঘণ্টা পড়ে থাকেন ওই মহিলা। পাশেই ঠায় বসে থাকেন শোকে কাতর বৃদ্ধ। 

    ওইদিন দুপুরে বলরামপুরের রাঙাডি গ্রামের যুবক চন্দন শর্মা বন্ধুদের সঙ্গে বরাভূম স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্ম থেকে বের হচ্ছিলেন। চন্দন বলছিলেন, ‘নেমেই দেখি কাপড়ে জড়ানো একটি দেহ প্লাটফর্মে পড়ে। পাশে এক বৃদ্ধ বসে। কথা বলে জানতে পারি, দেহটি তাঁর স্ত্রীর। এমন সময় রেলের কয়েকজন স্টাফ আসেন। তাঁরা বৃদ্ধকে দেহটি তুলে নিয়ে যেতে বলেন। অগত্যা বৃদ্ধ দেহটি কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। আমি সেই ঘটনার ভিডিও করি। বন্ধুরা মিলে প্রতিবাদ করি। বলরামপুর থানাতেও ফোন করি। এরপর নড়েচড়ে বসে রেল। দেহটি জিআরপি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়।’ 

    তবে, রেলের এহেন অমানবিক আচরণে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ থেকে নেট নাগরিকরা। একজন মৃত মহিলা কয়েক ঘণ্টা স্টেশনে পড়ে থাকার বিষয়টি জেনেও কেন এগিয়ে আসেননি কেউ? কেনই বা বৃদ্ধকে নিজের স্ত্রীর দেহ কাঁধে চাপিয়ে প্লাটফর্ম থেকে বের করতে হল? এনিয়ে স্টেশন ম্যানেজার কিছু বলতে চাননি। আদ্রা ডিভিশনের এডিআরএম খগেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, ‘ঠিক কি ঘটেছে, আমি জানি না। স্টেশন মাস্টারের থেকে খোঁজ নিয়ে দেখব।’
  • Link to this news (বর্তমান)