এক হাতেই গড়েন দশ হাতের নিখুঁত দুর্গাপ্রতিমা, সংগ্রামের অপর নাম ধনঞ্জয় ...
আজকাল | ২৬ আগস্ট ২০২৫
মিল্টন সেন, হুগলি, ২৫ আগস্ট: নিজের বাঁ হাত অকেজো। শুধুমাত্র ডান হাতেই গড়ে চলেছেন দশ হাতের দেবী দুর্গা। দুর্ঘটনায় ভেঙেছে কাঁধ। থেমে থাকেননি। সেই ভাঙা কাঁধেই বয়ে চলেছেন সংসারের হাল। মনের জোরে একহাতেই দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেন পোলবার বীরেন্দ্রনগর গ্রামের ধনঞ্জয় মিশ্র। তিনি প্রমাণ করেছেন ইচ্ছা শক্তি থাকলে সব বাধা অতিক্রম করা যায়। একহাতে নিখুঁত দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে চলেছেন। বছর দশেক আগে, সমাজের অন্য দশটা মানুষের মতোই ছিল ধনঞ্জয়ের জীবন। দু’হাত দিয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। হঠাৎই ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছে তাঁর জীবনের সব স্বপ্ন। ২০১৫ সালে তার জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় লরিতে ঠেকে যায় তার বাইকের হ্যান্ডেল। রাস্তা থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। তার উপর দিয়ে চলে যায় চার চাকা গাড়ি। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে টানা ২০ দিন কোমায় থেকে ফিরে আসেন শিল্পী। কাঁধে, মাথায় ও বাঁ হাতে গুরুতর চোট পান। বাঁ হাত ভেঙে পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়। এখনও কোনও কাজই বাঁ হাতে তিনি ঠিকভাবে করতে পারেন না। মাঝেমধ্যেই হয় তীব্র যন্ত্রণা। হারতে শেখেননি। তাই শত যন্ত্রণা সহ্য করেও এগিয়ে গেছেন জীবনযুদ্ধে। ২০ দিন কোমায় থাকার পর জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। আজও তিনি মনে করেন ঈশ্বরই তার ভরসা। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরেই ফের লেগে পড়েন এক হাতেই দুর্গা তৈরি করতে। এবছর তিনি দুটো দুর্গা তৈরি করার অর্ডার পেয়েছেন। প্রতিমার গায়ে মাটির কাজ প্রায় অর্ধেক শেষ। বাঁশ কাটা থেকে কাঠামো তৈরি করা, খর বাঁধা সবটাই তিনি নিজের হাতেই করেন। শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ক্রমশই রূপ ফিরে পাচ্ছে মৃন্ময়ী মূর্তি।
বয়স যখন মাত্র পাঁচ। তখন থেকেই মাটির কাজে তাঁর হাতেখড়ি। তখন পাড়ায় বিভিন্ন মৃৎশিল্পীদের মূর্তি তৈরি করা দেখতেন। এরপর আস্তে আস্তে নিজেই মূর্তি তৈরি করতে শুরু করেন। বাড়ির পাশেই খাল থেকে মাটি নিয়ে এসে চলতো তার মূর্তি গড়ার কাজ। দুর্গা ছাড়াও লক্ষ্মী ,গণেশ, সরস্বতী, কালী, জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তৈরি করেন তিনি। তবে এ বছর যেন তার প্রতি প্রকৃতিও বিমুখ। নিম্নচাপের জেরে গত কয়েক দিন ধরেই চলছে বৃষ্টি। তাঁর প্রতিমা তৈরির কাজ অধিকাংশই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বৃষ্টিতে প্রতিমার গায়ের মাটি খসে পড়ছে। পুনরায় তাঁকে আবার রূপ দিচ্ছেন শিল্পী। তাতে যেমন সময় নষ্ট হচ্ছে তাঁর, তেমনি সময়ে প্রতিমা বারোয়ারি পুজো কমিটিগুলিকে দিতে পারবেন কিনা তা নিয়েও দুশ্চিন্তার মেঘ জমেছে তাঁর মনে। বৃষ্টি এলেই প্রতিমায় ত্রিপল ঢাকা দিতে হচ্ছে। মাটির প্রতিমা ছাড়াও সিমেন্ট ও ফাইবারের মূর্তিও তৈরি করেন ধনঞ্জয়।
২০০৩ সালে আর্ট কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হন ধনঞ্জয়। সেখানে প্রতিমা তৈরি শেখেন। তার পাশাপাশি শেখেন বিভিন্ন ছবি আঁকা। বর্তমানে তাঁর কাছে প্রায় ৬০ জন ছাত্র–ছাত্রী আঁকা শেখেন। এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে তাঁর সংসার। ধনঞ্জয় বলেছেন, এক হাতে কাজ করতে তাঁর খুব সমস্যা হয়। তবে তাঁর স্ত্রী তাঁকে সাহায্য করেন। একটা দুর্ঘটনায় তাঁর বাঁ হাত নষ্ট হয়ে যায়। ডান হাত দিয়ে তাঁকে যাবতীয় কাজ করতে হয়। বাঁ হাতের ৭০ শতাংশ অসার। শুধুমাত্র মনের জোরে তিনি প্রতিমা তৈরি করেন। তিনি শুধু প্রতিমা নয়, কোনও মানুষকে দেখে তাঁর মূর্তি তিনি তৈরি করতে পারেন। ছোট থেকেই তিনি হারতে শেখেননি। জীবনে কখনও হারতেও চান না। স্ত্রী সুদীপ্তা মিশ্র বলেন, স্বামী একহাত দিয়ে কাজ করে। অনেক সমস্যা হয়। সংসার সামলে যতটা পারেন সাহায্য করেন। দেবীর পায়ে আলতা পরানো, মাটির গয়না তৈরি করা, শাড়ি পরানো এই সমস্ত ছোটখাটো কাজ তিনি করেন।