‘মাসিমা মালপো খামু’— ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায় বাংলার বরেণ্য কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই অসাধারণ সংলাপ আজও বাঙালির মনে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তাঁর জন্মের শতবর্ষ পেরিয়েছে। বর্ণময় জীবনে অসংখ্য নাটক, যাত্রা ও চলচ্চিত্রে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন এই মহান শিল্পী। ১৯২০ সালের ২৬ অগস্ট ঢাকা শহরের দক্ষিণ মইসন্দি অঞ্চলে শান্তিনিকেতন নামক বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা অভাবের মধ্যে কেটেছিল। নাটক, থিয়েটার ও সিনেমা দেখার মধ্যে দিয়ে অভিনয়ের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ জন্মেছিল। ‘সীতা’ সিনেমায় শিশির কুমারের অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই থেকেই অভিনয় জগতে শিশির কুমারই তাঁর কাছে বাস্তবের হিরো।
হাইস্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন ভানু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। বিএ পড়ার সময় প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কবি মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমউদ্দিন, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো প্রখ্যাত শিক্ষকদের সংস্পর্শে আসেন। সেই সময় মূলত নাটকে বিভিন্ন চরিত্রের অভিনয় দেখে মনে মনে ভবিষ্যতে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। স্বপ্নপূরণে যোগাযোগ ঘটে বিভিন্ন নাট্য প্রযোজকদের সঙ্গেও। রোগা চেহারা ও মিহি কণ্ঠস্বরের জন্য পরিচালকেরা বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাঁকে বেছে নেন। অভিনয় জীবনের প্রথম পর্বে ‘শাহজাহান’ নাটকে জাহানারা, মেওয়ারের পতনে মানসী, সরলা নাটকে সরলা নারী চরিত্রে অভিনয় করে নিজের অভিনয়সত্ত্বার জাত দর্শকদের চিনিয়েছিলেন। এর পরে অভিনয় জগতে তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
কৌতুক অভিনয়ে তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন ঢাকার শ্রীরমণী ঘোষাল। এ বিষয়ে তিনি আত্মকথায় জানিয়েছেন, ‘চন্দ্রগুপ্ত নাটকে আমাকে বাচালের ভূমিকায় দেওয়া হয়েছে। নন্দর চরিত্রে অভিনয় করেছে শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে একটা সিনে ঢোকার আগে আমার পোশাকে আরশোলা ঢুকে যায়। আরশোলা বের করে স্টেজে ঢুকতে আমার দেরি হয়ে যায়। কিন্তু নন্দবেশি শঙ্কর চুপ করে না থেকে বানিয়ে বানিয়ে সংলাপ বলতে থাকে— এই গৃহ অন্ধকার। আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্টেজে ঢুকে বানিয়ে বানিয়ে বলি, হোক অন্ধকার আরশোলার হাত থেকে তো বেঁচেছি। তা দেখে উইংসের পাশে দাঁড়ানো রমণীদার খুব ভাল লাগে। উনি আমাকে কমিক রোল করতে উৎসাহিত করেন।’
এই সময় ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন সারা ভারতে ব্যাপক আকার নিয়েছিল। বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে অন্যতম স্মরণীয় মুখ বিনয়-বাদল-দীনেশ। অভিনয়ের পাশাপাশি অল্প বয়সে অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন ভানু। ধীরে ধীরে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সংস্পর্শেও আসেন। দীনেশের শিষ্য হওয়ার সুবাদে ঢাকার গরুর গাড়ির গাড়োয়ানদের কাছ থেকে কুটটি ভাষা রপ্ত করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি ১৯৪৩ সালে কমিক স্কেচের রেকর্ড ‘ঢাকার গাড়োয়ান’ নামে বিভিন্ন ধরনের জোকস নানা জলসায় পরিবেশন করেছিলেন। তাঁর পরিবেশিত জোকস খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে ব্রিটিশ পুলিশের এক চরকে মারধরের ঘটনায় জড়িয়ে ঢাকা থেকে কলকাতায় পালিয়ে আসেন ভানু। কলকাতায় এসে নানা কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়ে উত্তর সারথী নামে একটি নাটকের দল প্রতিষ্ঠা করেন। নাটক থেকে সিনেমায় এসে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মনে জায়গা করে নেন। কলকাতায় এসে তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ছিল ‘অভিযোগ’। তবে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি হলেও প্রথম শুটিং করা ছবি ছিল ‘জাগরণ’। এর পরে যমালয়ে জীবন্ত মানুষ, শখের চোর, ভানু পেল লটারি, বরযাত্রী, ভুলি নাই-সহ প্রায় তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করে দর্শকের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেন।
ভানু বন্দোপাধ্যায় শুধু যে কমেডিয়ান হিসেবে পরিচিত ছিলেন তা নয়, তিনি সমাজসেবার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। প্রতি বছর শহিদ দিবসে বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেন। এই শ্রদ্ধা তাঁর দেশপ্রেম ও আদর্শের দায়বদ্ধতার প্রতীক।
বেঁচে থাকলে আজ ভানুর বয়স হত ১০৫ বছর। তবে ৬৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাংলা থিয়েটার ও সিনেমায় ঢাকাইয়া উচ্চারণে কৌতুক অভিনয়ে দক্ষতার যে পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তাতে দর্শক মনে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। পরবর্তী সময়ে আমরা অনেক কমেডিয়ান দেখেছি। অভিনয় সত্ত্বায় প্রত্যেকেরই নিজস্বতা ছিল। কিন্তু সব কৌতুক অভিনেতার শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে হয়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দক্ষ ভোকাল আর্টিস্ট বাংলা চলচ্চিত্র জগতে একেবারে বিরল।