শারদ উৎসবে মাতৃ বন্দনার কথা বলতে গেলে প্রথমেই উচ্চারিত হয় "রূপং দেহি, জয়ং দেহি", অর্থাৎ দুর্গা মায়ের মধুমাখা অদ্বিতীয় সেই রূপ, অসুর বিনাশিনী মাতৃরূপিনি মধুমাখা মায়ের অসাধারণ এই রূপ, শারদ উৎসবে ধরাধামে তার পূর্ণতা আনেন কুমোর পাড়ার মৃৎশিল্পীরা। প্রতি বছরেই এই সময়টা বড় ব্যস্ততায় কাটে তাঁদের। দম্ফেলার সময়টুকু থাকে না। এবার শুধু সময় কাটছে, সঙ্গে চিন্তায় কপালে ভাঁজ।
দুর্গোৎসব মানেই তো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, আহ্লাদ, আনন্দ, নতুন জামা কাপড় এবং প্রতিটি মানুষের ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যেমন মিলনের প্রাণকেন্দ্র। যেমন আনন্দের, উদযাপনের, তেমনই দুর্গাপুজো ব্যবসা-বাণিজ্যের, রোজগারের ভরকেন্দ্র হয়ে তাহকে এক পক্ষের। এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই মাতৃ প্রতিমা গড়ার প্রধান কান্ডারী মৃৎশিল্পীরা। একদিকে যেমন শরৎ-এর আকাশে সোনাঝরা রোদ আর শিশির ভেজা ঘাসের সঙ্গে সঙ্গে শিউলির গন্ধে মন মেতে ওঠে, একই সঙ্গে কাশফুলের গন্ধে দোলা লাগে মনে। দেবী দুর্গার আগমনের বার্তা মনমাতানো আবেগঘন চিত্ত উদ্বেলিত হয় আবাল বৃদ্ধ বনিতার। এই সব কিছুর মাঝে, গ্রামে-শহরে কুমোরপাড়ায় ধীরে ধীরে তৈরি হয় প্রতিমা। কাঠামো, মাটির প্রলেপ, রঙের ছোপ পেরিয়ে চোখ আঁকা হলেই, যত্নে গড়া প্রতিমা একে একে পাড়ি দেয়। কোনও প্রতিমা যায় মন্দিরে, বনেদি বাড়ির ঠাকুর দালানে, কোনও প্রতিমা যায় প্যান্ডেলে।
কিন্তু এই মৃৎশিল্পীরাই যদি অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করেন? যদি মৃৎশিল্পীরাই যদি চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শঙ্কায় ভোগেন? সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ের বাতাবরণ কমার বদলে যেন বাড়ছে আর। শ্রাবণ পেরিয়ে গিয়েছে, ক্যালেন্ডারের হিসেবে বর্ষাও। আর সেই পরিস্থিতি এবার প্রতিমুহূর্তে প্রতি ক্ষণে রাজ্যের আবহাওয়া দপ্তর বার্তা দিয়ে চলেছে আরো ভারী থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা। শুকোচ্ছে না জল, শুকাচ্ছে না মাটি, টানা স্যাঁতসেঁতে পরিস্থিতি। ফলে মাতৃপ্রতিমা গড়ার কারিগররা প্রতিমা নির্মাণে প্রতিমুহূর্তেই শঙ্কায় ভুগছেন। একদিকে ভাবনা, সময়ের মধ্যে কীভাবে প্রতিমা সাজিয়ে পাঠাবেন, অন্যদিকে ভাবনা, এই পরিস্থিতিতে কাজ সম্পন না হলে, রোজগার হবে কীভাবে?
প্রতিমা শিল্পীদের বক্তব্য, মাতৃ প্রতিমার বায়না আছে যথেষ্ট পরিমাণে, বায়না আসছে দূর দূরান্ত থেকে। কিন্তু তা পূর্ণ করা সম্ভব কতটা হবে সেটাই তো চিন্তার। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এতটাই ভয়াবহতা রূপ নিয়েছে যেন প্রতিমুহূর্তে লাল চোখ দেখাচ্ছে বজ্রবিদ্যুৎকে সঙ্গে নিয়ে, তার কারণে পরিস্থিতি যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিকূল হয়ে উঠেছে এই পরিস্থিতির মধ্যে।
এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কে দিনযাপনের কথা জানিয়েছেন মেদিনীপুর এগরার এক মৃৎশিল্পী। আবহাওয়া বিশারদদের মতে, এ বছরের বর্ষার ঘনঘটা ও ক্রমাগত নিম্নচাপের কারণে বৃষ্টি বিগত এক দশকেও দেখা যায়নি। আর এই বছর বৃষ্টির প্রকোপ এতটাই বেশি যেন মাটির জল শুকোতেই চাইছে না। যার ফলে মৃৎশিল্পীদের চোখের জলে নাকের জলে এক হতে হচ্ছে।
শহর কলকাতার কুমারটুলিতে মৃৎশিল্পীদের প্রতিমা গড়ার অত্যাধুনিক বেশ কিছু ব্যবহার রয়েছে এবং প্রতিমা শুকানোরও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা। এরপরেও শহর কলকাতার কুমারটুলির শিল্পীরা তাদের চিন্তার কারণ কোন অংশে কম নয়। এই ভয়াবহ বৃষ্টির কারণে আধুনিক পদ্ধতি থাকার পরেও আতঙ্কে ও ভয়ে দিনযাপন করছেন তাঁরা। কীভাবে দূর দূরান্ত থেকে আসা প্রতিমার বায়না সম্পূর্ণ করবেন সে নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন কুমারটুলির কারিগররাও। প্রাকৃতিকভাবে রোদের তাপ ঠিকমতো না থাকলে প্রতিমাকে সঠিক রূপদান করা যথেষ্টই কষ্টদায়ক। আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সাময়িক কিছু কাজ করা যেতে পারে কিন্তু বৃহৎ আকারে কোনও কাজ সম্পন্ন করা খুবই ব্যয়বহুল এবং একপ্রকার অসম্ভব বলেই জানাচ্ছেন শহর কলকাতার কুমারটুলির কারিগররা।
বলাবাহুল্য ঠিক এই জায়গায় আশঙ্কা প্রকাশ করে গ্রামবাংলার মৃৎশিল্পী মূলত এই মেদিনীপুরের মৃৎশিল্পী জানিয়েছেন, 'আমাদের কাছে কোনও অত্যাধুনিক পদ্ধতি নেই যার মাধ্যমে এই ধরনের কাজ সাবলীলভাবে সম্পূর্ণ করা যায়।' মূলত বছরের এই সময়টার জন্যই অপেক্ষায় থাকেন, কারণ এই সময় ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি ঘটলে তাই দিয়েই সারা বছর চলতে হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্দশার কথা জানাতে গিয়ে মেদিনীপুরের এগরার মৃৎশিল্পী স্বপন কুমার দাস বলেন, 'পরিবারের সকলে মিলে এই কাজ করি, পুজো আসলে আনন্দে থাকি রোজগার ভালো হবে এবং সেই রোজগারের আশাতেই থাকি সারা বছর। দুর্গাপূজো আসলেই যা প্রধান রোজগার হয়, বাকি বছর তেমন কিছু রোজগার হয় না। আর এবারের পূজোতে তো কাজই করতে পারছি না, অনেক দূর দূরান্ত থেকে বায়না এসেছে প্রতিমা গড়ার, কিন্তু ঠিকমতো সেই প্রতিমার প্রস্তুত করে দিতে পারব কিনা জানি না। যদি রাজ্য সরকার কিছুটা সহযোগিতা করে তাহলে কিছুটা হয়তো স্বস্তি পাব, কিন্তু জানি না কতটুকু করবে।'