দিব্যেন্দু সরকার: কথায় আছে, কুপুত্র যদিও বা হয়,কুমাতা কখনও হয় না। হ্যাঁ, এক কুপুত্রের অমানবিক মুখে তার ৮০ বছরের বৃদ্ধা মা-কে বাড়ির বাইরে থাকতে হচ্ছে ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যেই। বাড়ি থেকে মারধর করে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে গুণধর ছেলে। আবার সেই গুণধর ছেলে বিডিও অফিসে বলেও এসেছেন যে তার মা মৃত। বেঁচে নেই। প্রায় দেড় দুই মাস ধরে স্থানীয় একটি হাসপাতালের দুয়ারে একা পড়ে থাকেন এই আশি বছরের বৃদ্ধা। সামনেই জঙ্গল। সেই জঙ্গলে আবার শিয়ালের উপদ্রব। আর সেই ভয়ংকর স্থানেই একা রাতে পড়ে থাকেন। নির্মম, অমানবিকতার এই ঘটনায় বিচলিত এলাকার মানুষ জন। আবার এই বৃদ্ধা সরকারি প্রকল্পের কিছুই পাননি। না পেয়েছেন বিধবা ভাতা,না পেয়েছেন বার্ধক্য ভাতা। না পেয়েছেন বাংলার বাড়ি।
অবহেলিত জন্মদাত্রী:
এক ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে তাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। তারই মধ্যে মানবিক মুখ আছে বলেই হয় তো এখনও পৃথিবী সুন্দরই আছে। বৃদ্ধার এই অবস্থায় স্থানীয় এক চায়ের দোকান দার খোকন ধঁক তার স্বল্প আয় থেকেই দোকান থেকে চা ও পাঁউরুটি খাওয়ান। বিস্কুট দেন। আবার ঘুগনি মুড়ি খাওয়ান। দুপুরে স্থানীয় পুরশুড়া ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালের এক রাঁধুনি তাকে ভাত দিয়ে যান। কিন্তু সেখানেও আপত্তি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তাকে ভাত দেওয়া যাবে না বলেই শাসিয়েছে। তবে এই বৃদ্ধার পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় এক মহিলা তথা কবি ও সাহিত্যিক অপর্ণা মণ্ডল দত্ত। তিনি চেষ্টা করছেন যাতে সরকারিভাবে সমস্ত রকম সাহায্য তিনি পান।
পথে পথে এই বৃদ্ধার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে। স্বামী বেশ কয়েক বছর আগেই মারা গিয়েছেন।আর স্বামী মারা যাবার পরই এই বৃদ্ধা চাঁপা প্রামানিকের এই হাল হয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতি, বিডিও অফিস,স্থানীয় শ্রীরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কেউ কিছুই করেননি। উল্টে বিডিও অফিস থেকে তাকে বলা হয়েছে সব কিছুই দেওয়া হবে। কিন্তু কিছুই পাননি তিনি।
হাসপাতালে ঠাঁই:
হাসপাতালের সেই বৃষ্টি ভেজা দুয়ারে শুয়েছিলেন দুর্বল, অসুস্থ এই বৃদ্ধা চাঁপা। এই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে বলতে দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগল তাঁর। চাঁপা কান্না ভেজা কন্ঠে এই প্রতিনিধিকে জানান, 'আমাকে আমার ছেলে, বৌমা মেরে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার জায়গার দলিল কেড়ে নিয়েছে। আমার ঘরটা ভেঙে দিয়েছে। একবার বার্ধক্য ভাতা পেয়েছিলাম। তারপর থেকে আর পাইনি। বিডিও অফিসে গিয়েছিলাম সেখানে বলা হল দেওয়া হবে। কিন্তু কিছুই দিল না।'
সরকারের কাছে কাতর আর্তি:
কান্না ভেজা কণ্ঠে ফের চাঁপার গলায় শোনা গেল, 'সরকার আমাকে দেখুন। একটু যেন খেতে পাই। আর কত দিন রাস্তার মানুষ আমাকে দেখবে। ছেলেকে শাস্তি দিন।
গুণধর ছেলের লাঞ্ছনা:
এদিকে সেই গুণধর ছেলে গৌতমকে খুঁজে বের করে তার কাছে হাজির এই প্রতিনিধি। তিনি মায়ের কথা শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কে ওই মহিলা। আমার মা নয়। ওকে মেরে তাড়িয়েছি বেশ করেছি। আমাকে কিছুই দেয়নি। ও অপর একটি ছেলেকে জায়গা, জমি, টাকা পয়সা সবই দিয়েছে। আমি কি পেলাম। তাই তাড়িয়ে দিয়েছি। এখানে কোনও ঠাঁই নেই। ভয়ংকর পরিস্থিতিতে উনি বাস করছেন, এই প্রশ্নে ছেলের উত্তর যেমন ভাবে থাকুক না কেন আমি কিচ্ছু করব না।'
জি ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধির উপর চড়াও:
এর পরেই হাজির গুণধর ছেলের বাড়িতে যে বাড়িটাই এই বৃদ্ধার। সাংবাদিক শুনে রে রে করে ছুটে আসেন গৌতমের ছেলে। রীতিমতো ঠেলাঠেলি করে ক্যামেরা কেড়ে নেওয়ার উপক্রম। তেড়ে আসেন। বললেন,ক্যামেরা বন্ধ করুন। আমরা যা করেছি বেশ করেছি। ওই বৃদ্ধা কে বলুন যা করার করে নিক। এই প্রতিনিধিকেও ধাক্কা ধাক্কি করে অপমান করেন।
স্থানীয় চা ব্যবসায়ী খোকন ধঁক বলেন, গুণধর পুত্রের কীর্তি শুনুন। মেরে ধরে বের করে দিয়েছে। এরা কি মানুষ। আবার দেখুন ওঁর আধার কার্ড নিয়ে বিডিও অফিসে গিয়ে বলে এসেছেন যে, আমার মা মারা গেছেন। ভয়ংকর এই ঘটনায় অভুক্ত আশি বছরের এই বৃদ্ধা। আমি আমার সাধ্যমতো দিই ওঁকে। তবে ভয় হয় কোথায় জানেন? এখানে প্রচন্ড শিয়ালের উপদ্রব। তাই ভয় হয় শিয়ালে যেন কোন দিনই ওকে টেনে নিয়ে যায়। তা নাহলে জীবনটাই চলে যাবে। আপাতত ওঁর বাঁচার জন্য লড়াই করছেন স্থানীয় এক গৃহবধূ অপর্ণা মণ্ডল দত্ত। তিনি বলেন, 'আমি চেষ্টা করছি যাতে সরকারি ভাবে উনি সমস্ত রকম যা যা প্রাপ্য তাই তাই যেন পান। ওঁকে দেওয়া হোক।