গত দু’দশকে মহানগরে লাফিয়ে বেড়েছে অভিজাত বহুতল! এখন সেখানকার বাসিন্দারা ভোটের কাব্যে উপেক্ষিত নন, বরং জরুরি
আনন্দবাজার | ১৭ আগস্ট ২০২৫
ওঁরা থাকেন ও ধারে। উঁচু পাঁচিল আর প্রকাণ্ড গেটের ও ধারে।
কলকাতায় এককালে ওঁদের ভোট কোনও কোনও বুথের ফলাফলকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখত। পরে সে প্রভাব বেড়ে বেশ কিছু ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হয়ে উঠেছিল। এখন ওঁরা বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলেও ছাপ ফেলার ক্ষমতা রাখেন। অবশ্য যদি সকলে মিলে ভোটের সকালে সুউচ্চ বহুতল থেকে নেমে এসে ভোটের লাইনে দাঁড়ান তবেই।
২০০০ সালের আগে পর্যন্ত কলকাতায় এমন অভিজাত বহুতল আবাসন বা কমপ্লেক্সের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। চলতি সহস্রাব্দের শুরু থেকে মহানগরে এই ধরনের বহুতল বাড়তে শুরু করে। ২০০৫ সালের পর থেকে সেই গতি আরও বাড়ে। গত ১০ বছরে কলকাতা এবং তার উত্তরে বারাসত-ব্যারাকপুর পর্যন্ত, উত্তর-পূর্বে রাজারহাট-নিউটাউন, দক্ষিণ-পূর্বে সোনারপুর এবং দক্ষিণে জোকা-পৈলান পর্যন্ত অভিজাত বহুতলের সংখ্যা রকেটের গতিতে বেড়েছে। আশ্চর্য নয় যে, এই সব আবাসনের বাসিন্দারা প্রায় আলাদা একটি শ্রেণি বা ভোটব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছেন।
কলকাতার প্রাক্তন মহানাগরিক শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আপাতত কলকাতায় অভিজাত বহুতল আবাসন ও কমপ্লেক্সের সংখ্যা হাজার দু’য়েক বা তার একটু বেশি। শহরের ভোটার তালিকায় তাঁদের অংশীদারিত্ব ৮-১০ শতাংশের মতো।’’
অতএব আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে একটি দল চাইছে, কলকাতার উচ্চকোটির বহুতল আবাসন তথা কমপ্লেক্সগুলির বাসিন্দাদের ভোটদানে উৎসাহ বাড়াতে। আর এক দল বছরভর সে সব বহুতল চত্বরে প্রতিটি পাতা নড়া এবং পড়ার খবরাখবর রেখে চলেছে। এককালে ওঁদের ভোট দেওয়া আটকে দেওয়ার চেষ্টা করত ‘সংশয়ী’ শাসক। কারণ, সাধারণত শহুরে বহুতলের বাসিন্দারা ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ হয়ে থাকেন। তাঁদের মতামত সাধারণত যায় শাসকের বিরুদ্ধে। ফলে তাঁদের আটকে দিলে শাসকের সুবিধা হত বৈকি। কিন্তু মহানগরের ভোটার তালিকায় বহুতলের বাসিন্দাদের ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের হিসাবের দিকে নজর রেখে এ বার সকলকে কৌশল বদলাতে হচ্ছে।
যে রাজ্যে ভোটের সামগ্রিক ফলাফলে শাসক ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে ৮-১০ শতাংশেরই ফারাক থাকে, সেখানে বহুতলবাসীদের সম্মিলিত ভোটের হিসাব গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার ক্ষেত্রে সে হিসাব অবশ্য একটু আলাদা। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী কলকাতার দু’টি আসনেই জয়ী তৃণমূল। দ্বিতীয় বিজেপি। দুই আসনেই তাদের মধ্যে ফারাক ১০ শতাংশের বেশি। ফলে সব অভিজাত বহুতলের ভোট একত্রিত হয়ে এক দিকে পড়লেও ফলাফল উল্টে যেত না। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে হিসাবটা তেমন না-ও হতে পারে। কারণ, বিধানসভা কেন্দ্র ভেদে অভিজাত বহুতলের সংখ্যায় ফারাক রয়েছে। বেশ কয়েকটি বিধানসভা আসনের ফলাফল বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন এই অভিজাত বহুতলগুলির বাসিন্দারা।
বিরোধী দল বিজেপি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এই বহুতলগুলির বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর নতুন কৌশল নিয়েছে। রাজ্য স্তরে কমিটি তৈরি করা হয়েছে। নাম ‘বহুতল সমিতি’ (হাইরাইজ় কমিটি)। কলকাতা, শহরতলি এবং দুর্গাপুরের মতো শহরে অভিজাত বহুতল আবাসনগুলির বাসিন্দাদের সঙ্গে দলের যোগাযোগ বাড়ানোর দায়িত্ব এই কমিটির। যদিও বিজেপির জাতীয় পরিষদ সদস্য তথা দক্ষিণ কলকাতা ‘বহুতল সমিতি’র ইনচার্জ শতরূপা একে ‘সম্পূর্ণ নতুন’ কৌশল বলতে রাজি নন। তাঁর দাবি, ‘‘অভিজাত বহুতলগুলির সঙ্গে আমরা গত ১৪-১৫ বছর ধরেই যোগাযোগ রেখে চলি। আমি ২০১১ সালে বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী ছিলাম। সেবারেও আমি একাধিক বহুতলে গিয়ে প্রচার করেছিলাম। বহুতলে প্রচারে যাওয়ার জন্য যে আলাদা সময় রাখতে হয়, তা আমি তখন থেকে জানি।’’ কিন্তু বিজেপির তরফে রাজ্য স্তরের কমিটি গঠন করে বহুতলবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ ‘নতুন’, শতরূপা তা মানছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতার অভিজাত বহুতলগুলির বাসিন্দারা অশান্তি পছন্দ করেন না। অশান্তির ভয়েই তাঁদের একটা অংশ ভোট দিতে যেতে চান না। তবে তার চেয়ে বড় একটা অংশ রয়েছে, যাঁরা প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ না নিলেও নিজের ভোটটা নিজে দিতে চান। এঁদের সিংহভাগই এখন বিজেপির দিকে।’’
কেন বিজেপির দিকে, কেন তৃণমূলের দিকে নয়, সে ব্যাখ্যা দিয়েছেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্রের এক বহুতলবাসিনী শিক্ষাবিদ। তাঁর কথায়, ‘‘বাইরের ঝুটঝামেলা এড়িয়ে ঘেরাটোপের ভিতরে উচ্চমানের জীবনযাত্রার খোঁজেই লোকে এই ধরনের কমপ্লেক্সে আসে। কিন্তু তাতেও এখন সারা বছর ঝুটঝামেলা এড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। জলের নতুন লাইন বসানো থেকে বৈদ্যুতিক কাজ, বহুতল চত্বরে ছোটখাটো যে কোনও কাজের খবর কিছু নেতা রাখতে শুরু করেছেন। তাঁরা নিজের নিজের এলাকায় প্রভাবশালী। সে প্রভাব কাজে লাগিয়ে তাঁরা সরাসরি ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে নিজেদের দাবিদাওয়া জানিয়ে দেন। এই সব কাণ্ডকারখানায় অভিজাত বহুতলগুলির বাসিন্দাদের অনেকেই বিরক্ত।’’
দক্ষিণ কলকাতার এক তৃণমূল কাউন্সিলরের অবশ্য পাল্টা বলছেন, ‘‘দরজায় দরজায় যোগাযোগ রাখতেই হবে। অভিজাত বহুতল যতই গেট বন্ধ করে বাঁচুক, এলাকার কাউন্সিলরকে তো তাঁদের খোঁজখবর নিতে হবে। আমরা সারা বছর সেটা করি। সেখানকার বাসিন্দাদের নানা প্রয়োজনে পাশে থাকি। তাই বিজেপির মতো আলাদা কমিটি তৈরি করে আমাদের যোগাযোগ বাড়ানোর দরকার পড়ে না।’’
তৃণমূল কাউন্সিলর ‘আত্মবিশ্বাসী’ হলেও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট যে, কলকাতার দুই আসনেই অভিজাত বহুতলগুলিতে বিজেপির ভোট বেড়েছে। উল্টেডাঙার এক বহুতলে বিজেপি বেশি ভোট পাওয়ায় আবাসন চত্বরে শ’খানেক অটোরিক্সা ঢুকিয়ে, তারস্বরে ডিজে বাজিয়ে এবং ভাঙচুর চালিয়ে আতঙ্ক তৈরির অভিযোগ ওঠে স্থানীয় কয়েকজন তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। একই কারণে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে মোহিনীমোহন রায় রোডের এক আবাসনেও ইটপাটকেল ছোড়ার অভিযোগ ওঠে। একটি আবাসনের সামনে আবর্জনার ফেলে রাখার অভিযোগও ওঠে।
ঘটনাচক্রে, ভোটের দিন অভিযোগ উঠেছিল, একাধিক বহুতলের বাসিন্দাদের ভোট দেওয়া আটকানোর চেষ্টা হচ্ছে। ভবানীপুর বিধানসভা এলাকার তৃণমূল কাউন্সিলর অসীম বসুর বিরুদ্ধে কোনও কোনও বহুতলের মূল ফটকে তালা ঝোলানোর অভিযোগ উঠেছিল। যে অভিযোগ বাম জমানায় একাধিক বার উঠেছে। ভোটের সকালে বহুতলের গেটের সামনে বোমার আওয়াজও শুনেছে কলকাতা। অশান্তির আঁচ পেয়ে অধিকাংশ বাসিন্দা ভোট দিতে বেরোতেন না। তাঁদের ভোট অবশ্য ‘পড়ে যেত’।
সিপিএমের অন্যতম সেরা ‘ভোট ম্যানেজার’ হিসেবে পরিচিত রবিন দেব অবশ্য এখন আর সে সব প্রসঙ্গে যেতে চান না। তাঁর কথায়, ‘‘ও সব পুরনো কথা টেনে লাভ কী? বাবারও বাবা থাকে। কেউ বাম জমানার কথা বললে আমি কংগ্রেস জমানার কথা বলতে পারি। কংগ্রেস আবার ব্রিটিশ জমানার কথা টানতে পারে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘এখন কী হচ্ছে, সেটা নিয়ে কথা হওয়া জরুরি। আগে এমন হয়ে থাকলে ভুল হয়েছে। এখনও ভুলই হচ্ছে। সেই ভুলটাকে শুধরে নেওয়াই কর্তব্য। সে দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কমিশন আগে স্বচ্ছ ভাবে ভোটার তালিকাটা তৈরি করুক। তার পরে নিশ্চিত করুক, সকলে নির্ভয়ে এবং নিরাপদে ভোট দিতে পারবে আর ভোটের পরেও কোনও হিংসা হবে না।’’
গত পুর নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ওয়ার্ডে বিজেপির প্রার্থী ইন্দ্রজিৎ খটিক বলছেন নির্বাচনভেদে বহুতলগুলির বাসিন্দাদের ভোটদানের হার আলাদা। তাঁর কথায়, ‘‘পুরসভার নির্বাচনে বহুতলের বাসিন্দারা তেমন মাথা ঘামান না। কিন্তু লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে এঁদের অধিকাংশই ভোট দিতে যান। ৭০-৭২ শতাংশ ভোট তো পড়েই।’’ এই দাবিতে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, কেন এখন সব দলকেই অভিজাত বহুতলবাসীদের ভোট নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করতে হয়েছে। ইন্দ্রজিতের কথায়, ‘‘এঁরা গোলমাল এড়িয়ে সকাল সকাল ভোট দিয়ে আসেন। প্রাতঃর্ভ্রমণ থেকে ফেরার সময়ে ভোটের বুথে যান। তাই প্রথম কয়েক ঘণ্টায় বেশির ভাগ বুথে যখন ৫ শতাংশের মতো ভোট পড়ে, তখন কিছু বুথে ১৫ শতাংশের মতো ভোট পড়ে যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই বুথগুলির মধ্যে বহুতল আবাসন রয়েছে।’’
আশ্চর্য নয় যে, রাজনৈতিক দলগুলিকে বহুতলের বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক স্থাপনের কথা আলাদা করে ভাবতে হচ্ছে। বস্তুত, ভোটের দিনের জন্য বহুতলের বাসিন্দাদের কথা ভেবে নির্বাচন কমিশনকেও আলাদা বন্দোবস্ত নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেই ৬০০ জনের বেশি ভোটার সম্বলিত বহুতলগুলির ক্ষেত্রে আবাসন চত্বরেই ভোটকেন্দ্র খোলার কথা ভেবেছিল কমিশন। কিন্তু সে ভাবনা বাস্তবায়িত হয়নি। কেন হয়নি, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিজেপি নেতা শিশির বাজোরিয়ার দাবি, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের দলদাস পুলিশ বিভিন্ন আবাসনে গিয়ে চাপ দিয়ে বাসিন্দাদের দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছিল যে, তাঁরা আবাসন চত্বরে ভোটকেন্দ্র চান না।’’ শিশিরের আরও অভিযোগ, কমিশনের কেন্দ্রীয় স্তরের কর্তাদের ইচ্ছা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের ‘সদিচ্ছা’ ছিল না। তিনি বলেন, ‘‘আমরা বার বার বলেছিলাম, কমিশন যদি মনে করে কোথাও ভোটকেন্দ্র হবে তা হলে তা হবে। কারও বারণ শোনার বাধ্যবাধকতা কমিশনের নেই। কিন্তু মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতর ‘দেখছি-দেখব’ করে সময় কাটিয়ে দিয়েছিল। আশা করছি এ বার সেই পরিস্থিতি পাল্টাবে। কলকাতার বহুতলের বাসিন্দাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে।’’
সিপিএমের ‘ভোটের রবিন হুড’ অবশ্য তা মনে করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘কমিশন যদি সকলের নির্ভয়ে, নিরাপদে ভোট দেওয়া এবং ভোটের পরে হিংসা ঠেকাতে না পারে, তা হলে আবাসন চত্বরে কেন, ফ্ল্যাটের ভিতর বুথ বানিয়েও লাভ হবে না!’’