কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামেই প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন ফুটবল যোদ্ধারা
বর্তমান | ১৫ আগস্ট ২০২৫
অগ্নিভ ভৌমিক কৃষ্ণনগর
সালটা ১৯৭১। বর্ষার এক উত্তাল বিকেল। চারিদিকে থমথমে পরিস্থিতি। ওপার বাংলায় তখন চলছে জীবন-মরণের লড়াই। একদিকে পাকিস্তানের নির্মম দমননীতি, অন্যদিকে সদ্য ভাগ হওয়া নদীয়া জেলার মানুষের চোখে জল আর উদ্বেগ। ওপার বাংলায় থেকে যাওয়া আত্মীয়-পরিজনদের জন্য তাঁদের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। মনে চিন্তা, কেমন আছেন তাঁরা? এখনও বেঁচে আছেন তো?
নদীয়ার বহু মানুষ স্বাধীনতার পর উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন এপার বাংলার নানা শিবিরে। কিন্তু, হৃদয়ে তখনও গেঁথে ছিল তাঁদের গ্রামের কথা, তার স্মৃতি, আর নির্ভেজাল শিকড়ের টান। সেই স্মৃতিই যেন হঠাৎ জেগে উঠেছিল এক অনন্য দিনে। যেদিন নদীয়ার কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামের মাটিতে গর্জে উঠেছিলেন একদল ‘ফুটবল যোদ্ধা’। তাঁদের মিশন ছিল স্বাধীনতা। শুধু তাঁদের অস্ত্র ও প্রতিবাদের ভাষা ছিল ফুটবল। পশ্চিম পাকিস্তানের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ঠিক তখনই এক দল তরুণ, প্রাণোচ্ছ্বল ফুটবলার গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য দল—‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। ৩৫জনের সেই স্কোয়াড বন্দুকের পরিবর্তে বেছে নেয় ফুটবলকে। তাঁরা খেলার মাঠকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রতিবাদের ময়দান হিসেবে। তাঁদের একটাই লক্ষ্য—মুক্তিযুদ্ধের তহবিল গড়ে তোলা এবং সেইসঙ্গে ভারতজুড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি করা। কারণ, তখনও খাতায়-কলমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই, কৃষ্ণনগরের স্টেডিয়াম যেন ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছিল। সেদিন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল মুখোমুখি হয়েছিল নদীয়া জেলা ক্রীড়া সমিতি দলের সঙ্গে। এটিই ছিল স্বাধীন বাংলা দলের প্রথম প্রদর্শনী ম্যাচ। গ্যালারিতে গিজগিজ করছে দর্শক। চারদিক সাজো সাজো রব। মাইকে ভেসে আসছে প্রাণজুড়ানো দেশাত্মবোধক গান—‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। স্বাধীন বাংলা দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু নিজের হাতে ওড়াচ্ছেন লাল-সবুজ পতাকা। পাশে সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। একে একে মাঠে নামছেন নূরন্নবী, আবদুল হাকিম, বিমল কর, আইনুল হক, সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান প্রমুখ।
সেই দিনের ম্যাচে ফলাফল হয়েছিল ২-২। কিন্তু, এই ম্যাচের আসল জয় ছিল খেলোয়াড়দের সাহস, প্রতিবাদ, আর এক নতুন জাতির আত্মঘোষণার। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল সারা ভারতে ১৭টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে পাওয়া কয়েক লক্ষ টাকা জমা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। তাঁদের এই বৈপ্লবিক উদ্যোগ আসলে ছিল প্রতিবাদের এক অন্য রূপ। তেমনি ছিল ভালোবাসা, জাতীয়তাবোধ, আর নিজের দেশের জন্য কিছু করার অদম্য তাগিদ।
তারপর পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। কিন্তু, আজও কৃষ্ণনগরের বয়স্ক মানুষরা সেই দিনের কথা স্মরণ করেন। গর্ব করেন এই বলে যে, তাঁদের শহরের মাঠেই একদিন ফুটবলের মাধ্যমে ঘোষণা হয়েছিল বাংলাদেশের আত্মপরিচয়। একদল তরুণ ফুটবলার আজ ইতিহাসের অংশ। আর সেই ম্যাচ আজও অমর হয়ে আছে নদীয়ার বুকজুড়ে।কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম। -নিজস্ব চিত্র