• স্বাধীনতা আন্দোলনে তেহট্টের কর বন্ধ আন্দোলন সারা ভারতের নজরে আসে
    বর্তমান | ১৫ আগস্ট ২০২৫
  • সৌরভ ভট্টাচার্য , তেহট্ট: কর বন্ধ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল তেহট্ট থানার চাঁদেরঘাট গ্রাম। নদীয়া জেলায় প্রথম কর বন্ধ আন্দোলন শুরু হয় চাঁদেরঘাটে। এই গ্রামের ছেলে সতীশ সর্দার কর বন্ধ আন্দোলনে ব্রিটিশ পুলিসের গুলিতে মৃত্যু বরণ করে প্রথম শহিদ হন। তারপর সারা দেশে স্বাধীনতা আন্দোললে উঠে আসে তেহট্টের নাম। এমনকি ১৯৩২ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যা কাণ্ডের প্রতিবাদে চাঁদেরঘাটে একটা জনসভা হয়। সেই জনসভায় জাতীয় পতাকা তুলে চাঁদের ঘাটকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়। প্রায় ৫২ ঘণ্টা চাঁদেরঘাট স্বাধীন ছিল পরাধীন ভারতবর্ষে। 

    স্বাধীনতা আন্দোলনে নদীয়া জেলার অন্যতম পীঠস্থান ছিল তেহট্ট। তেহট্টের মধ্যে চাঁদেরঘাট গ্রাম ছিল নদী দিয়ে ঘেরা। ফলে সেই জায়গাকে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বেছে নিয়েছিল আন্দোলনের পীঠস্থান হিসাবে। ১৯৩২ সালে ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চাঁদেরঘাটে এক জনসভার ডাক দেয় কংগ্রেস। সেই সময় কৃষ্ণনগরের জেলা কংগ্রেস সদস্য হরিপদ  চট্টোপাধ্যায় ওখানে গিয়ে কর বন্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি ঘূর্ণি এলাকায় বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে আত্মগোপন  করেছিলেন। 

    তিনি ব্রিটিশদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই চাঁদের ঘাটে ওই সমাবেশে যোগ দেন। তিনি এলাকার মানুষদের বোঝাতে সক্ষম হন এই কর দেওয়া যাবে না। তারজন্য ইংরেজ পুলিসের নির্যাতন হাসি মুখে মেনে নিতে হবে। এই আন্দোলনে পুলিস হরিপদ বাবুকে গ্রেপ্তার করলে অংসখ্য মানুষ বাধা দেন। তিনি সবাইকে বুঝিয়ে নিরস্ত করেন। এরপর ওই এপ্রিল মাসে চাঁদের ঘাটে কর বন্ধ আন্দোলন কেন্দ্রীভুত হয় ও জেলা কংগ্রেসের অফিস ওই এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। কংগ্রেস নেতৃত্ব সকলকে নির্দেশ দিলেন এই আন্দোলনে চাঁদেরঘাটে গিয়ে যোগদান করতে। 

    সেই মতো কৃষ্ণনগর থেকে সরোজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ সরকার, হরিদাস মুখোপাধ্যায়, গৌরীশঙ্কর চক্রবর্তী, কুমারেশ মোদক, দ্বিপেন চক্রবর্তী  বর্তমানের বাংলাদেশের কুষ্টিয়া থেকে অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নিশীথরঞ্জন আচার্য , কুমুদ রায়, মৃণালিনী দেবী মেহেরপুর থেকে ননীগোপাল সিংহ, মাধবেন্দু মোহন্ত, ধর্মদা থেকে রামপদ রাহা, বেথুয়াডহরি থেকে সাবিত্রী দাস তেহট্টের শ্যামাপদ ভট্টাচার্য সহ সাধারণ মানুষ এই কর বন্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই আন্দোলনের ফলে গ্রামের পর গ্রাম কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এই সময় এই আন্দোলনে সভা ডাকা হয়েছে শুনলে নিমেষে জন সমাগম হয়ে যেত। এই আন্দোলন বন্ধ করার জন্য পুলিস অত্যাচার শুরু করে। নৌকা ডুবিয়ে রাখা থেকে সব কিছু করেও এই আন্দোলন দমাতে পারেনি ইংরেজরা। 

    ১৯৩২ সালের ১৯ জুন কর বন্ধ আন্দোলনের দ্বিতীয় অধিবেশন ডাকা হয়। এই অধিবেশন বন্ধ করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই অধিবেশনের অন্যতম নেতা হরিদাস মুখোপাধ্যায়কে কৃষ্ণনগর স্টেশনে আটকে দেয় পুলিস। ধীরেন্দ্রনাথ সরকারকে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে নজরবন্দি রাখা হলেও তিনি পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে এই আন্দোলনে সামিল হন। তেহট্টে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে। যদিও এই সম্মেলনে পুলিস ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। তবু সম্মেলন হয়েছিল। এই সম্মেলনে যোগ দিতে আসা নেতাদের পুলিস গ্রেপ্তার করে।  সেজন্য জনতার সঙ্গে পুলিসের বচসা শুরু হয়। সেই সময় পুলিস গুলি চালায়। পুলিসের গুলিতে শহিদ হন চাঁদেরঘাটের তরুণ সতীশ সর্দার। 

    এই ঘটনার পরই তেহট্টের নাম সারা বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরোভাগে চলে আসে। আর এই কর বন্ধ আন্দোলনে চাঁদেরঘাটের ভূমিকা সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। 

     তথ্যসূত্র ফিরে দেখা নদীয়া প্রথম খণ্ড, লেখক এসএম তাজিরুল  ইসলাম।
  • Link to this news (বর্তমান)