ভাগ্যিস সেদিন জেলাটা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়নি, আজও স্বাধীনতা দিবসে স্বস্তির নিশ্বাস নেন রানাঘাটের বাসিন্দারা
বর্তমান | ১৫ আগস্ট ২০২৫
দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: র্যাডক্লিফ সাহেবের নকশা মেনে দেশভাগের সিদ্ধান্ত মেনে নিলে আজকের রানাঘাট থাকত বাংলাদেশের অধীনে। কিন্তু, ধনী-দরিদ্র, যুবক-বৃদ্ধ থেকে আপামর নদীয়াবাসীর সমবেত প্রতিরোধে শেষমেষ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় নদীয়া। তাও দেশ স্বাধীন হওয়ার তিনদিন পর। সেই সময়ের বেঁচে থাকা প্রবীণ-প্রবীণারা প্রত্যেকেই আজও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, ‹ভাগ্যিস সেদিন জেলাটা পাকিস্তানে চলে যায়নি।
পশ্চিমে পাঞ্জাব এবং পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ, দেশভাগের যে চরম যন্ত্রণা এই রাজ্য দুটি দেখেছে। তা হয়তো অনুভব করতে পারবে না আর কেউই। কিন্তু, রানাঘাট সহ সমগ্র নদীয়া? তার অভিজ্ঞতার ঝুলি নেহাত অল্প নয়। কারণ র্যাডক্লিফের নকশা অনুযায়ী প্রথমে পাকিস্তানে চলে যাওয়া, অতঃপর গণপ্রতিরোধের জেরে ভারতভুক্তি। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষের আগমন, কী নেই অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস এলেই তাই নাড়া দিয়ে যায় সেই দুর্দিনের স্মৃতিগুলি।
১৫ আগস্ট ১৯৪৭, সারা দেশজুড়ে যখন উদ্যাপিত হচ্ছে স্বাধীনতা দিবস। তখন নদীয়াবাসী পড়ে আতান্তরে। কারণ, তারা নাকি পূর্ব পাকিস্তানের অংশ! অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঘোষণা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। শোনা যায়, তৎকালীন পাকিস্তান সেনা কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি দখলের জন্য উদ্যত হয়। আর এটাই ছিল গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠার আগুনে প্রথম ঘৃতাহূতি। তৎকালীন কৃষ্ণনগরের রাজা সৌরিশচন্দ্র থেকে রানি জ্যোতির্ময়ীদেবী সহ আম আদমির চেষ্টায় টালমাটাল পরিস্থিতি কাটে আগামী দু›দিন। পাকিস্তান কোনওভাবেই মঞ্জুর নয় নদীয়াবাসীর। অবশেষে ১৭ আগস্ট নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ঠিক হয় নদীয়াকে দ্বিখণ্ডিত করে নবদ্বীপ এবং কুষ্টিয়া তৈরি হচ্ছে। কুষ্টিয়া যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে এবং নবদ্বীপ জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে কৃষ্ণনগর এবং রানাঘাট মহকুমা ভারতের অংশ হচ্ছে। নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ১৮ আগস্ট, অর্থাৎ স্বাধীনতার তিনদিন পর নদীয়ার মাটিতে ওড়ে প্রথম তেরঙ্গা। এখনও এই বিশেষ দিনটিকে স্মরণে রেখে ১৫ আগস্টের পাশাপাশি ১৮ আগস্টও নদীয়ার বহু জায়গায় জাতীয় পতাকা তোলা হয়। সেইসঙ্গে উদ্যাপিত হয় নদীয়া জেলার স্বাধীনতা দিবস।
শুধু কী এখানেই শেষ? ঐতিহাসিকরা বলেন, খানিক সামলে উঠতে না উঠতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ থেকে কাতারে কাতারে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষের আগমন। যারা ভিটেমাটি ছেড়ে এক কাপড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজও তার স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে কুপার্স ক্যাম্প এলাকাজুড়ে। একইভাবে ধুবুলিয়া ক্যাম্প, শিবনিবাস সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্বাধীনতা এবং একাত্তরের ইতিহাস। তার অধিকাংশই কেউ মনে রেখেছে আবার কেউ মনে রাখেনি। যেমন কুপার্সজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের সেনা ছাউনি থেকে সে যুগের হাসপাতাল। যা আজও জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করে চলেছে পরাধীন যুগের। ১৯৭১ সালে ভিটেমাটি হারিয়ে এই দেশে চলে আসা এমনই এক বৃদ্ধ পরিমল হালদার বলেন, দেশান্তর কী জ্বালা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। মাথার ছাউনি তো দূরে থাক, না আছে পেটে খাবার না আছে পরনের কাপড়। কতদিন শুধু জল খেয়েই দিন কেটেছে তার হিসেব রাখিনি। পরাধীনতার জ্বালা আর পিতৃপুরুষের ভিটে হারানোর যন্ত্রণা একসঙ্গে সইতে পারা কী চাট্টিখানি কথা? প্রসঙ্গত, এখন প্রতিবেশী দুই দেশ অর্থাৎ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে বুক কেঁপে ওঠে রানাঘাট সহ নদীয়াবাসীর। ইতি-উতি কান পাতলেই প্রবীণদের আলোচনায় শোনা যায় এক স্বস্তির উক্তি। ‹ভাগ্যিস সেদিন জেলাটা পূর্ব পাকিস্তানের থেকে যায়নি।