জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: ২০২৬ নির্বাচনের আগে এবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুন করে উত্তেজনার পারদ চড়ল। সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) চলা এক মামলার শুনানিতে উঠে এল চাঞ্চল্যকর এক তথ্য, যা রাজ্য এবং নির্বাচন কমিশনের (Election Commission) মধ্যেকার টানাপোড়েনকে আরও স্পষ্ট করে তুলল। রাজ্যের আইনজীবী গোপাল শঙ্করনারায়ণ আদালতকে জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন ৮ আগস্ট রাজ্য সরকারকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে 'স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন রিসার্চ' (SIR) প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে। এই খবর সামনে আসতেই রাজনৈতিক ও আইনি মহলে নতুন করে বিতর্কের ঝড় উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল:
যখন SIR সংক্রান্ত মামলাটির শুনানি চলছিল, তখন বিচারপতি সূর্যকান্ত রাজ্যের আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন যে পশ্চিমবঙ্গে কি ইতিমধ্যেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে? বিচারপতি যখন মন্তব্য করেন, 'পশ্চিমবঙ্গে এখনও SIR শুরু হয়নি', ঠিক সেই মুহূর্তে রাজ্যের আইনজীবী গোপাল শঙ্করনারায়ণ কমিশনের পাঠানো চিঠির প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি জানান, কমিশনের চিঠিই প্রমাণ করে যে, তারা ইতিমধ্যেই এই প্রক্রিয়া শুরুর জন্য উদ্যোগী হয়েছে এবং খুব শীঘ্রই তা কার্যকর হতে চলেছে।
রাজ্যের বক্তব্য:
এসআইআর প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কেন ২০০৩ সালের ভোটার তালিকাকে ধরা হচ্ছে? কেন ২০২৫ সালের জানুয়ারির তালিকা ধরা হবে না? বিষয়টি উল্লেখ করে মামলাকারীর আইনজীবী গোপালের উদ্দেশে বিচারপতি বাগচীর মন্তব্য, ‘এটা (এসআইআর) প্রথম বারে জন্য করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সকল ভোটার তালিকা বাতিল করা যেত। কিন্তু কমিশন তা করছে না। তারা ২০০৩ সালকে ‘মাইলস্টোন’ হিসাবে ধরে নিচ্ছে।’ বিচারপতি বাগচী মামলাকারীর আইনজীবীকে বলেন, ‘২০০৩ সাল কেন? কেন ২০২৫ সালের জানুয়ারির তালিকা ধরা হবে না? আপনারা এই বিষয়ে সওয়াল করতে পারেন।’
শুনানিতে মামলাকারীর আইনজীবী গোপালের সওয়াল, 'সংবিধান সব ব্যক্তিকে ভোটার হওয়ার অধিকার দিয়েছে। জনপ্রতিনিধি আইনে ভোটারের সংজ্ঞা দেওয়া রয়েছে।’ তার পরেই খসড়া ভোটার তালিকায় নাম বাদ যাওযার প্রসঙ্গ নিয়ে গোপালের মন্তব্য, 'কমিশন গণহারে নাম বাদ দিয়েছে। ভোট দেওয়া আমার অধিকার। ভারত নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে গর্ব করে। কমিশন কী ভাবে ভোটারদের সঙ্গে এই রকম ছেলেখেলা করতে পারে?'
SIR নিয়ে চাঞ্চল্য:
আইনজীবীর এই মন্তব্যের পরই আদালত কক্ষে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। গোপাল শঙ্করনারায়ণ কমিশনের এই পদক্ষেপ নিয়ে তীব্র আপত্তি জানান। তিনি বলেন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা না করেই, বা তাদের মতামত না নিয়ে কী ভাবে কমিশন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া শুরু করার দিকে এগোচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তিনি বলেন, এটি রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যেকার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অবজ্ঞা করার শামিল। রাজ্যের পক্ষ থেকে এই প্রক্রিয়াকে একতরফা এবং অগণতান্ত্রিক বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়:
এর আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'এত দুর্বল সরকার ভারতবর্ষের মানুষ দেখেনি। মজবুত সরকার নয়, মজবুর সরকার। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সরকার মজবুর হয়ে গেছে। বিজেপির বড় নেতাদের মার্জিন কমে গেছে। তাই এরা এখন SIR করছে। টাকা দিচ্ছে না, এবার ভোটাধিকার কেড়ে নেবে। কারণ মানুষ ভোট দিলে তো এরা জিতবে না। দুই কোটি ভোটার বাদ দেওয়া তো দূর অস্ত, দুজনের নাম বাংলায় বাদ দিয়ে দেখাক বুঝিয়ে দেব কত ধানে কত চাল'।
তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। বিহারের মানুষ এর জবাব দেবে বলে বিশ্বাস। বাংলায় করতে আসলে তৃণমূলের উপর মানুষের ভরসা আরও বাড়বে। বৈধ একজন ভোটারেরও নাম বাদ দিতে দেব না। প্রয়োজনে দিল্লিতে এসে বৃহত্তর আন্দোলন করা হবে। কোনও SIR হল না, আগেই বিজেপি নেতারা বলে দিচ্ছে বাংলা থেকে দু কোটি ভোটার বাদ যাবে। ইলেকশন কমিশন বিজেপির হয়ে কাজ করছে। মানুষের আস্থা আছে তৃণমূলের উপর। তাই বিহারের মতো বাংলায় হবে না, হতে দেবে না তৃণমূল। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ৮ দফায় বাংলায় ভোট করিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
লোকে ভোট দিতে না পারে সেই জন্য এই ব্যাবস্থা করেছিল। বিজেপির ঘোড়া আটকে গিয়েছিল ২৪০ -এ এসে। এবার আরও কমবে।'
কমিশনের বক্তব্য:
রাজ্য সরকারের এমন আপত্তিতে কমিশন এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই পদক্ষেপ রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত। এর ফলে একদিকে যেমন নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার তদন্তে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে, তেমনই রাজ্য ও কমিশনের মধ্যেকার আইনি ও রাজনৈতিক বিরোধ আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কমিশনের এই সিদ্ধান্তের আইনি বৈধতা এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আগামী দিনে আরও জটিল মামলা দেখা যেতে পারে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিবেশ এমনিতেই উত্তপ্ত। তার ওপর এই SIR-এর ঘোষণা সেই আগুনে যেন নতুন করে ঘি ঢালল। অনেকেই মনে করছেন, এই প্রক্রিয়া শুরু হলে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনাগুলির তদন্ত আরও দ্রুত হতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি রাজ্য সরকারের ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে। আদালত এখন এই বিষয়ে কী রায় দেয়, তার ওপরই নির্ভর করছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ।