প্রতি বছর বর্ষায় রূপনারায়ণ নদে ইলিশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন নন্দকুমারের ইচ্ছাপুর গ্রামের সরোজ মণ্ডল, মহিষাদলের অমৃতবেড়িয়া গ্রামের উত্তম বেরারা। বর্ষার কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেলেই জোয়ারের সময় জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রূপনারায়ণে। এ বারও মাছ ধরতে বাড়ির কাছে রূপনারায়ণে জাল পেতেছিলেন তাঁরা। কিন্তু এ বার সরোজ, উত্তমেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কম ইলিশ জালে ধরা পড়েছে, ক্ষতি সেই কারণে নয়। বরং তাঁদের জাল ছিঁড়ে যাচ্ছে সেচ দফতরের ফেলা বাঁশের খাঁচায়!
তমলুক থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে দনিপুর এলাকায় ইচ্ছপুর থেকে মহিষাদলের গেঁওখালি পর্যন্ত অংশে রূপনারায়ণে ইলিশ ধরা হয়। ইচ্ছাপুর, মীরপুর, দনিপুর, অমৃতবেড়িয়া, বাড় অমৃতবেড়িয়া, ভোলসরা, বাকা প্রভৃতি গ্রামের তিন শতাধিক মৎস্যজীবী ৫০টির বেশি নৌকা করে ইলিশ ধরতে যান। এই দনিপুর এলাকাতেই রূপনারায়ণের পাড়ের ভাঙন সমস্যা রয়েছে। তাই ইচ্ছাপুর থেকে অমৃতবেড়িয়া পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে এবং বাঁধ রক্ষায় সেচ দফতর ‘ব্যাম্বু পর্কুপাইন’ পদ্ধতিতে বাঁশের খাঁচা পাড়ের কাছে ফেলছে। অভিযোগ, নিয়ম মেনে পর্যাপ্ত ইট খাঁচায় না ভরে সেগুলি জলে ফেলা হচ্ছে। এতে খাঁচাগুলি পাড় থেকে দূরে মাঝ নদীতে চলে যাচ্ছে। সেই খাঁচতেই জড়িয়ে যাচ্ছে মৎস্যজীবীদের জাল। এবং সেগুলি ছিঁড়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানাচ্ছেন, একটি নৌকায় পাঁচ, ছ’জন মিলে তাঁরা নদে জাল ফেলতে যান। প্রতি নৌকায় প্রায় ২৫০ (প্রতি গাছায় থাকে ১৯ হাত দীর্ঘ জাল) গাছা জাল থাকে। যে জালের দাম প্রায় দু’লক্ষ টাকা। জোয়ারের সময়ে স্রোতের আড়াআড়ি জাল পেতেই ইলিশ মাছ ধরা হয়। বর্ষার মরসুমের শুরু থেকেই মৎস্যজীবীরা রূপনারায়ণে জাল পেতে ইলিশ ধরছিলেন। কিন্তু অনেক মৎস্যজীবীদেরই জাল ছিঁড়ছে।
ইচ্ছাপুরের মৎস্যজীবী সরোজ বলেন, ‘‘কয়েকদিন আগে আমরা নৌকা নিয়ে জোয়ারের সময়ে জাল পেতেছিলাম। সেই জালে বাঁশের খাঁচায় আটকে যায়। আমার ৩০-৩৫ গাছা জাল ছিঁড়েছে। গত জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে বাঁশের খাঁচা ফেলা হচ্ছে। তারপর থেকেই এই সমস্যা হচ্ছে।’’ অমৃতবেড়িয়ার উত্তম বলেন, ‘‘আমরা জালেও বাঁশের খাঁচা আটকেছে।জাল ঢেঁড়ার ভয়ে অনেকেই মাছ ধরতে যাওয়া বন্ধ করেছেন।’’
শুধু সরোজ বা উত্তম নন, ভরা বর্ষার মরসুমে জাল ছেঁড়ার ভয় পাচ্ছেন অন্য মৎস্যজীবীরাও। তাঁদের জীবিকায় টান পড়ছে বলে দাবি। মৎস্যজীবীদের প্রশ্ন, ‘ব্যাম্বু পর্কুপাইন’ পদ্ধতিতে কি আদৌও নিয়ম মেনে বাঁশের খাঁচা ফেলা হচ্ছে? যদি নিয়ম মানা হয়, তা হলে খাঁচা ভেসে মাঝ নদে চলেই বা যাচ্ছে কী করে?
সেচ দফতর সূত্রের খবর, ‘ব্যাম্বু পর্কুপাইন’ পদ্ধতিতে ইট ভর্তি বাঁশের খাঁচা ফেলতে প্রায় চার কোটি ৭৮ লক্ষ চাকা ধরা হয়েছিল। ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র ডাকা হয়। নিয়মানুযায়ী, দরপত্রে অংশ নেওয়া সংস্থাগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন দর (এক কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা) দেওয়া ঠিকাদার বরাত পান। ঠিকাদারদেরই একাংশের অভিমত, এত কম টাকার মধ্যে কাজ করা হলে তার গুনমাণ বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়ে দফতরের নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে দাবি।
এ ব্যাপারে সেচ দফতরের তমলুক মহকুমা আধিকারিক সৈনভ সিন্হা অবশ্য বলছেন, ‘‘কাজের গুনগত মাণ ঠিকঠাক রয়েছে কি না, তা নিয়মিত ভাবে দফতরের তরফে নজর রাখা হয়। বাঁশের খাঁচা ভেসে গিয়ে তাতে মৎস্যজীবীদের জাল ছেঁড়া সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ আসেনি।’’