• পরিযায়ী-সন্ধানে বিজেপি-ও, যুব মোর্চার নজরে ভিন্‌রাজ্যে কর্মরত ১০ লক্ষ যুবা, রাজ্যে ‘একলাখি’ বাহিনী গড়ার চেষ্টা
    আনন্দবাজার | ১৩ আগস্ট ২০২৫
  • তৃণমূল একা নয়। পরিযায়ী-সন্ধানে বিজেপিও। ভিন্‌রাজ্যে বাঙালি (মূলত পরিযায়ী শ্রমিক) হেনস্থার অভিযোগ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন আন্দোলনে নেমেছেন, তখন বিজেপিও ‘হাতিয়ার’ করতে চাইছে ভিন্‌রাজ্যে কর্মরত বাঙালিদেরই (এক অর্থে তাঁরাও পরিযায়ী)। তবে মমতা যে ২২ লক্ষ ‘পরিযায়ী’ বাঙালির কথা বলছেন, বিজেপির নজর তাঁদের দিকে নয়। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র-সহ বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থায় কাজ করতে বঙ্গের যুবাদের অনেকেই এখন দিল্লি, গুরুগ্রাম, নয়ডা, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদে। ওয়েবসাইট খুলে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি শুরু করছে বঙ্গ বিজেপির যুব মোর্চা। তাঁদের সাহায্য করতে মাঠে নামানো হচ্ছে অন্যান্য রাজ্যের যুব মোর্চা কর্মীদেরও।

    কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বিভিন্ন রাজ্যের (মূলত বিজেপিশাসিত) প্রশাসন মাসখানেক ধরে ‘বাংলাদেশি’ চিহ্নিতকরণ অভিযান জোরদার করেছে। কিন্তু তার জেরে ‘ভারতীয়’ বাঙালিদেরও হেনস্থা হতে হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূলের দাবি। এমনকি, যাঁদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ইতিমধ্যেই সে দেশে ফেরত পাঠানো (পুশ ব্যাক) হয়েছে, তাঁদেরও কেউ কেউ আসলে ‘বাংলাদেশি’ নন বলেই তৃণমূলের দাবি।

    বিজেপি এর ঠিক বিপরীত প্রচারে জোর দিচ্ছে। তাদের দাবি, মমতার সরকার ‘পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ’কে কাজে লাগিয়ে আসলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে। বিজেপির বড় অভিযোগ, ভিন্‌রাজ্যে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত অনেককে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতীয়ত্বের নথি পাইয়ে দিয়েছে, যাঁরা আসলে অনুপ্রবেশকারী।

    তৃণমূল-বিজেপির এই দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যে ফারাক যতটা, পরিযায়ী ভোটব্যাঙ্ক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও দু’দল তেমনই দুই মেরুতে। দু’দলের নজর পুরোপুরি আলাদা দু’টি শ্রেণির উপরে। যাঁরা কাজের ধরন এবং আর্থ-সামাজিক মাপকাঠি, দু’দিক থেকেই আলাদা।

    মমতা যে ২২ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের কথা বলছেন, তাঁদের কেউ নির্মাণশিল্পে দিনমজুরি করেন, কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, কেউ অলঙ্কারশিল্পী, আবার কেউ খেতমজুর। এ ছাড়াও অসংগঠিত ক্ষেত্রের আরও নানা পেশায় এঁরা কর্মরত। এঁদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। হরিয়ানা হোক বা মহারাষ্ট্র, দিল্লি হোক বা তামিলনাড়ু (বিজেপিশাসিত নয়), ‘বাংলাদেশি’ চিহ্নিতকরণ অভিযানে এই শ্রেণির পরিযায়ী শ্রমিকদেরই মূলত বিপাকে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ।

    পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিন্‌রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া আরও একটি শ্রেণি রয়েছে। তাঁদের সবচেয়ে বড় অংশ রয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে। তা ছাড়াও রয়েছেন গবেষক, অধ্যাপক, প্রযুক্তিবিদ, চিকিৎসক, আইনজীবী। বাণিজ্য এবং হোটেল ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রেও অনেকে কাজ করেন। এর পুরোটাই কর্পোরেট তথা সংগঠিত ক্ষেত্র। এঁদের উপার্জন এবং জীবনযাত্রা তুলনায় খানিক উচ্চশ্রেণির। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নিরিখেও এঁরা এগিয়ে। সে কারণেই ভিন্‌রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে বাংলায় কথা বললেও এঁদের হেনস্থা হতে হচ্ছে না। এঁদের অনেকে সমাজমাধ্যমে সে কথা জানাচ্ছেনও। বঙ্গ বিজেপির যুব মোর্চা এই ‘পরিযায়ী’ বা‌ঙালিদের সঙ্গেই যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্র মিলিয়ে এই ধরনের পরিযায়ী বাঙালির সংখ্যা ৩৬ লক্ষের আশেপাশে।

    বিজেপির মুখপাত্র রাজ চৌধুরী বলছেন, ‘‘রাজ্যের বাইরে কর্মরত ১০ লক্ষ যুবক-যুবতীর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করব। কারণ, মোট সংখ্যা ৩৬ লক্ষের মতো হলেও তাঁরা সকলে যুবসমাজের নন। সকলেই যে এখনও পশ্চিমবঙ্গের ভোটার, তা-ও নয়।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য রাজ্যে গিয়ে কর্পোরেট ক্ষেত্রে কাজ করছেন এবং যাঁরা এখনও পশ্চিমবঙ্গেরই ভোটার, আমরা তাঁদের সঙ্গেই যোগাযোগ করছি।।’’ যুব মোর্চার আবেদন, এঁদের মধ্যে যাঁরা ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার পালাবদল চান, তাঁরা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নাম নথিভুক্ত করে ‘পরিবর্তন’ অভিযানে নিজেদের ভূমিকা নিন।

    এই পরিযায়ীদের সঙ্গে বঙ্গ বিজেপির যোগাযাগের মাধ্যম হয়ে উঠছে অন্যান্য রাজ্যের বিজেপি। তারাও নিজেদের যুব শাখাকে ময়দানে নামাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের যুব মোর্চাকে সাহায্য করতে। মুম্বই, তেলঙ্গানা, হরিয়ানা এবং দিল্লির যুব মোর্চা ইতিমধ্যেই সেই অভিযানে নেমেছে। এর পরে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, ওড়িশা ও তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যেও স্থানীয় যুব মোর্চাকে সক্রিয় করা হবে। ওই সব রাজ্যে কর্মরত কর্পোরেট বাঙালি যুবাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বঙ্গের যুব মোর্চার ওয়েবসাইটের সঙ্গে পরিচিত করানো হবে।

    আগামী ১৭ অগস্ট ওয়েবসাইটটি আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ্যে আনা হবে। সেই ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করানোর মাধ্যমে রাজ্যের বাইরে বসেও রাজ্যের রাজনীতির সঙ্গে ভার্চুয়ালি জুড়ে থাকা যাবে। বিভিন্ন বিষয়ে বিজেপির ভাষ্য তাঁদের কাছে নিয়মিত পৌঁছে দেওয়া হবে। বিজেপির নির্বাচনী ‘সংকল্পপত্রে’র বিষয়ে তাঁদের পরামর্শও নেওয়া হবে। চলতি বছরের শেষ দিকে বা নতুন বছরের শুরুতে কলকাতায় কোনও ‘উচ্চ গুরুত্বের’ ইনডোর কর্মসূচিতে এঁদের আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে।

    ১০ লক্ষের মধ্যে কত জনকে টানা যাবে বলে যুব মোর্চা আশাবাদী? সংগঠনের রাজ্য সহ-সভাপতি গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, অধিকাংশকেই। কিন্তু তৃণমূল যে ২২ লক্ষ পরিযায়ীর কথা বলছে, তার সাপেক্ষে ১০ লক্ষ তো কম! গৌতম বলছেন, ‘‘ওই ২২ লক্ষের মধ্যে যাঁরা তৃণমূলকে ভোট দেন, তাঁরা আগের নির্বাচনগুলিতেও দিয়েছেন। যাঁরা দেননি, তাঁরা এ বারও দেবেন না। তৃণমূল নতুন কোনও ভোটব্যাঙ্ক পাবে না।’’ বিজেপি যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, তাঁরা যে এত দিন বিজেপিকেই ভোট দিচ্ছিলেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? গৌতম বলছেন, ‘‘আমরা যে শ্রেণির সঙ্গে যোগাযোগ করছি, তাঁদের বড় অংশ তো ভোট দিতেই আসতেন না। আমাদের লক্ষ্য তাঁদের সকলকে নিয়ে আসা।’’

    ওয়েবসাইটটির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গেও অন্তত এক লক্ষ যুবক-যুবতীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরিকল্পনা করেছে যুব মোর্চা। তার জন্য ২৫ হাজার গ্রামকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে গ্রামের সংখ্যা ৪০,২১৮। জনবসতি রয়েছে ৩৭,৪৭৮টি গ্রামে। যুব মোর্চার হিসাব বলছে, অন্তত আট হাজার গ্রামে শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাস, আরও কয়েক হাজার গ্রামে ‘সন্ত্রাসে’র পরিস্থিতি। তাই বেছে নেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার গ্রামকে। পাশাপাশি ১০০-র বেশি পুরসভা এবং সাতটি নগরনিগমেও বুথে বুথে জনসংযোগ কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)