পাচারচক্রে নারীর নিলাম ‘প্রথা’ রাজস্থানে, বর্ধমানের নাবালিকা পাচারে গ্রেপ্তার ৬
প্রতিদিন | ১২ আগস্ট ২০২৫
সৌরভ মাজি, বর্ধমান: বাঙালি শ্রমিকদের বাংলাদেশি সন্দেহে অত্যাচার বিজেপিশাসিত রাজ্য। আর বাঙালি মেয়েরা পণ্য বিজেপিশাসিত রাজস্থানে। সেখানে রীতিমতো নিলাম করে বেচাকেনা হয় বাংলার নাবালিকাদেরও। একবার নয় বারবার হাত বদল হয় মোটা টাকায়। জাল নথিতে সাবালিকা দেখিয়ে লোকদেখানো বিয়েও দেওয়া হয় পাচার করা নাবালিকাদের। নারীপাচারচক্রের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে রাজস্থান। দেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এজেন্ট। ভুল বুঝিয়ে নাবালিকাদের নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বেচাকেনা চলে সেখানে। সেখানে কার্যত ক্রীতদাসী বানিয়ে রাখা হয় পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের। কলকারখানায় ‘বন্ডেড লেবার’-এর প্রচলন বহু যুগ ধরে শোনা যায়। রাজস্থানে পাচার হওয়া নারীরা বন্ডেড লেবার নন। কার্যত বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা ও বাবুদের যৌন লালসার শিকার হন। অসম্মত হলে শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হতে হয়। এক নিখোঁজ নাবালিকার খোঁজে রাজস্থান গিয়ে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে সিবিআই। অন্য একটি ঘটনায় একই তথ্য পেয়েছে পুলিশও।
কিছুদিন আগে পূর্ব বর্ধমানের গলসি থানার পুলিশ নিখোঁজ এক নাবালিকাকে রাজস্থান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এক এজেন্টের মাধ্যমে তাকে সেখানে পাচার করা হয়েছিল বলে পুলিশ জানতে পারে। এবার সিবিআই-ও বিজেপিশাসিত ওই রাজ্য থেকে এই জেলারই রায়নার এক নাবালিকাকে উদ্ধার করেছে। পাচারকারী সন্দেহে এক মহিলা সহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা সকলেই রাজস্থানের বাসিন্দা। রাজস্থানের পালি জেলার মারোয়ার জংশন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শনিবার পেশ করা হয় ধৃতদের। তিনদিনের ট্রানজিট রিমান্ডে তাদের বর্ধমানে নিয়ে আসে সিবিআই। অন্যদিকে, এই পাচার চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে আসানসোল থেকেও দুই জনকে গ্রেফতার করে সিবিআই।
সোমবার ধৃত ৭ জনকে বর্ধমানের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে পেশ করা হয়। তদন্তের স্বার্থে রাজস্থান থেকে ধৃত ভরত কুমার, জগদীশ কুমার, রাতা রাম, দিলীপ কুমার ও মিনা দোপুপেন-দের আটদিনের হেফাজতে নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানায় সিবিআই। বিচারক বিভাস চট্টোপাধ্যায় তা মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি আসানসোল থেকে ধৃত রানু খাতুন ও মহম্মদ বিলালকেও এদিন আদালতে পেশ করে আটদিনের হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই। উদ্ধার হওয়া ছাত্রীকে নিজের কাছে রাখার জন্য আবেদন জানান তাঁর মা। নাবালিকা তার মায়ের কাছে যাওয়ার বিষয়ে মত প্রকাশ করে বিচারকের সামনে। নাবালিকাকে তার মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। এদিন নাবালিকার মা পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে আদালতে আবেদন জানান। সিবিআইয়ের আইনজীবীও নাবালিকা ও তার পরিবারের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার কথা আদালতের সামনে তুলে ধরেন। তার ভিত্তিতে নাবালিকার বাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। এছাড়াও কেসের প্রয়োজনে নাবালিকার যে কোনও জায়গায় যাতায়াতের সময় উপযুক্ত পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্যও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। জেলার পুলিশ সুপার ও রায়না থানার ওসিকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, রায়না থানার খালেরপুল মাছখাণ্ডা এলাকায় এক নাবালিকা ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ প্রাইভেট টিউশন পড়তে যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আর বাড়ি ফেরেনি। প্রথমে রায়না থানা ঘটনার তদন্ত করে। অপহরণের সন্দেহে এলাকার দুই যুবক শেখ সফিকুল ও শেখ জসিম উদ্দিন নামে দুই যুবককে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। কিন্তু নাবালিকার সন্ধান মেলেনি। পরে তারা জামিনও পেয়ে যায়। এরপর ঘটনার তদন্তভার নেয় সিআইডি। তারাও খুঁজে দিতে পারেনি নাবালিকাকে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন নাবালিকার মা। বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত ঘটনার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। সিবিআইয়ের স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডিএসপি রাজেন্দ্র হেমন্ত কুজুরের নেতৃত্বে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়।
সম্প্রতি গলসি থানার পুলিশ সেখানকার এক নিখোঁজ নাবালিকাকে রাজস্থান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এরপরই সিবিআই পাখির চোখ করে রাজস্থানকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে সিবিআই জানতে পারে নাবালিকাকে পাচার করা হয়েছে রাজস্থানে। সিবিআইয়ের একটি টিম রাজস্থানের পালি জেলায় রওয়ানা দেয়। শুক্রবার রাতে ওই নাবালিকাকে উদ্ধার করে। পাচারের অভিযোগে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। সিবিআই সূত্রে খবর, রাজস্থানে একটা বড় মানব পাচারচক্র রয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিশেষত নাবালিকাদের নিয়ে গিয়ে জাল এফিডেভিট দিয়ে বয়স বাড়িয়ে সাবালিকা দেখানো হয়। তার পর পাইকারি বাজারের মতো নিলাম হয়। ৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি দর ওঠে নিলামে। সর্বোচ্চ দর যে দেয় নাবালিকা তার হয়ে যায়। আবার সে নিয়ে গিয়ে অন্যত্রও বিক্রি করতে পারে। একইভাবে সেখানেও নিলামে বিক্রি হয়ে হাতবদল হয়ে যায় নারী।
এদিন ধৃতদের বর্ধমান আদালতে পেশ করে হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা জানতে চান, তাদের হয়ে স্থানীয় এজেন্ট কারা ছিল। স্থানীয় এজেন্ট ছাড়া রাজস্থান থেকে এসে কোনও নাবালিকাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তার সন্ধান পেতে চাইছে সিবিআই। পাশাপাশি, আর কোনও নাবালিকা বা তরুণী এই চক্রের খপ্পরে পড়ে পাচার হয়েছে কি না সেটাও জানতে চাইছেন তদন্তকারীরা। মামলার তদন্তকারী অফিসার মামলায় ধর্ষণ ও পকসো অ্যাক্টের ৪ ও ৬ ধারা এবং চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্টের ৯ ও ১০ ধারা যুক্ত করার জন্য এদিন আবেদন জানান। এ ব্যাপারে ১৮ আগস্ট শুনানি হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।