• বাংলাভাষাকে ‘বাংলাদেশি’ বলা মানে এ দেশের আপামর বাঙালিকেই অ-নাগরিক করা
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১২ আগস্ট ২০২৫
  • স্বপনকুমার মণ্ডল

    বেশ কিছুদিন ধরেই মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে শোরগোল ফেলে দেয়। তার আসল রহস্য ক্রমশ ঘটনাপরম্পরায় উন্মোচিত হতে থাকে। সেখানে শুধুমাত্র বাঙালি পরিযায়ীদের উপরে নির্বিচারে যেভাবে আক্রমণ নেমে এসেছে, তা থেকেই তার আসল লক্ষ্য বেরিয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে এ দেশ থেকে বিতাড়নের প্রয়াসে যেভাবে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্মম অত্যাচারের কথা ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে আপনাতেই বাঙালিবিরোধী আবহ প্রকট মনে হয়। রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করার স্বার্থে বাংলাভাষা থেকে বাঙালি আজ ভয়ঙ্কর সংকটের মুখে। নবান্নে দিল্লি পুলিশের পাঠানো একটি চিঠিতেই বাঙালির ভাষাকেই বাংলা না বলে ‘বাংলাদেশি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিজেপি-র আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য আবার সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই। অর্থাৎ প্রথমে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাঙালি মুসলমানদের ভাষাকে বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করার মধ্যে যাও-বা সে দেশের অঞ্চল ভেদে দুর্বোধ্য আঞ্চলিক উপভাষার যুক্তি খোঁজার অবকাশ ছিল, অমিত মালব্যর অভিনব মূল্যায়নে তাও আর রইল না। অন্যদিকে বাঙালির প্রতি ভিন্‌রাজ্যের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষী মনোভাব জাগিয়ে তোলার প্রয়াস বর্তমান, তা এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এমনিতেই বাঙালিবিরোধী মানসিকতা অবাঙালিদের মধ্যে বর্তমান। বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের অবৈধ নির্যাতন থেকে আটক এবং পুশব্যাক করে বাংলাদেশে পাঠানোর আবর্তের মধ্যেই আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সেরাজ্যে বাঙালিরা সেন্সাসের সময় বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা লিখলে বিদেশি চিহ্নিতকরণ সহজ হবে বলে যে ভয়ঙ্কর হুমকি দেন, তা শুধু সেই রাজ্যেরই নয়, দেশের আপামর বাঙালির মধ্যেও নতুন করে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এ তো রীতিমতো বাঙালিবিদ্বেষ। এমনিতেই সেখানে আশির দশক থেকে বাঙালি ‘খেদাও’ তথা বিতাড়নের ট্র্যাজিক ইতিহাস এখন আরও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সমান সক্রিয় যা গভীর উদ্বেগজনক। সেই ইতিহাসের সঙ্গে NRC বা CAA-এর জুজু জুড়ে অনুপ্রবেশকারী বিদেশিদের চিহ্নিত করার আয়োজনে আতঙ্কিত বাঙালির মনে অস্তিত্ব সংকটের নিবিড় হাতছানি জেগে থাকে। তার উপরে সেন্সাসে ‘বাংলা মাতৃভাষা মানেই বিদেশি’র সিদ্ধান্ত তথা মাতৃভাষা বাংলা লেখার দায়ে বাঙালি না বুঝিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কথায় বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণের সুবিধার চেতাবনি তো দেশান্তর করার আগাম হুঁশিয়ারি প্রকাশ। নির্বাচন কমিশনে বিহারের ভোটার তালিকা বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা SIR-এর প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বাতাবরণে তা আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। এরপর যে পশ্চিমবঙ্গের পালা। শুরু হবে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের কর্মযজ্ঞ, তাও একপ্রকার আতঙ্কিত চেতাবনি। সেক্ষেত্রে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, বাংলা বললেই বাংলাদেশি ধরে নেওয়ার আতঙ্ক বাঙালিমাত্রেরই গভীর উৎকণ্ঠায় বিষয় হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে গেলেও বাঙালি এখনও ভারতীয় হতে পারল না, বাংলাদেশি থেকে গেল, ভাবা যায়!

    মাতৃভাষা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। সব মাতৃভাষা ভাষা হয়ে ওঠে না, সব ভাষাও মাতৃভাষার গরিমা পায় না। আসলে মাতৃভাষা মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো অবিচ্ছেদ্য। এজন্য দেশান্তর হলেও লোকের মাতৃভাষা একই থেকে যায়। কারও মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়া মানেই তার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলা। এই মাতৃভাষার গরিমাকে আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে দিয়েছে বাংলাভাষাই। শুধু তাই নয়, ভাষার অধিকার আদায়ে বাংলাভাষীরাই একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছে। সে দেশটির নামই বাংলাদেশ। আর যে দেশটি বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে সাহায্য করেছে, তার নাম ভারত। অখণ্ড ভারতবর্ষ থেকেই ধর্মভেদে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র থেকে সময়ান্তরে তিনটি স্বাধীন দেশ হয়েছে। অথচ বাঙালির ঐক্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধারকবাহক বাংলাভাষার গৌরব তাতে কমেনি। ভারতে হিন্দির পরেই বাংলাভাষায় সবচেয়ে বেশি লোক কথা বলে। এ দেশের জাতীয় সঙ্গীত থেকে জাতীয় স্ত্রোত্র কৃতী বাঙালিদ্বয়ের লেখা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত এ পার বাংলার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতেও রবীন্দ্রনাথের অবদান অনস্বীকার্য। সেক্ষেত্রে বাঙালির গৌরব ও গর্ব তার মাতৃভাষা বাংলা। সেই ভাষাই দেশের সংবিধান স্বীকৃত ভাষা। বাংলাকে ২০২৪-এ ধ্রুপদি ভাষার বনেদি মর্যাদা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারই প্রদান করে। এই ভাষা থেকেই শুধু ভারতেই নয়, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার এসেছে। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, অখণ্ড ভারতে বঙ্গদেশেই দুই বার নবজাগরণ ঘটেছে। ষোড়শ ও উনিশ শতকের নবজাগরণের বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। উনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণে বাংলা সাহিত্যেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে অখণ্ড ভারতে প্রথম বাংলা ভাষাই আন্তর্জাতিক খ্যাতি পায়। অন্যদিকে দেশের প্রথম আধুনিক ভারতীয় একজন বাঙালি। তাঁর নাম রাজা রামমোহন রায়। শুধু তাই নয়, বাংলা চলচ্চিত্রেই ভারতরত্ন সত্যজিৎ রায় অস্কার পুরস্কার লাভ করেন। অথচ বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই বলেই তাকে বাংলাদেশি নামকরণ করা অত্যন্ত গর্হিত ও ঘোরতর অন্যায় মনে হয়। বাংলাভাষাকে অস্বীকার মানে বাঙালিকেই শুধু অপমান করা নয়, তার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করা। বাংলাদেশের ভাষা ‘বাংলাদেশি’ নয়, শুধুই বাংলা। সে দেশের মানুষের জাতীয়তা ‘বাংলাদেশি’। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বাংলাভাষার রকমারি আঞ্চলিক উপভাষা আছে। বাংলাভাষার পাঁচটি মুখ্য উপভাষার একটি পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে বর্তমান। তার নাম বঙ্গালি। সেটিকে ‘বাংলাদেশি’ ভাষা বলেও কাউকে সেই ভাষায় কথা বলতে শুনলেও তাকে বাংলাদেশি বলা যায় না। কেননা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ট্র্যাজিক পরিণতিতে ভারতে আসা অসংখ্য বাঙালি সেই প্রাণের ভাষা বঙ্গালি উপভাষাকে বয়ে এনেছে। আসলে মাতৃভাষা তো মায়ের ভাষাই নয়, ভাষাটাই মা। সে মায়ের সঙ্গে নাড়ির যোগ অবিচ্ছেদ্য। এজন্য এ পার বাংলার অসংখ্য মানুষের ভাষাতেও বাংলা মায়ের আপন ভাষা শোনা যায়।

    অন্যদিকে, বাঙালি মুসলমান মানেই বাংলাদেশি নয়। ধর্ম ভেদে দেশভাগের পরেও অসংখ্য বাঙালি মুসলমান এ দেশকেই স্বদেশ ভেবে থেকে গিয়েছেন। তাঁরা এ দেশের খাঁটি নাগরিক এবং দেশপ্রেমিক। তাঁদের মুসলমান বলে দাগিয়ে দিয়ে দেশছাড়া করা দেশপ্রেম নয়, তা আসলে দেশদ্রোহীতা। তার প্রতিবাদ জরুরি। অন্যদিকে দেশের সার্বিক সুরক্ষার স্বার্থে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের আইনমাফিক বিতাড়ন করা একান্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) অত্যন্ত জরুরি। তা নিয়ে কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। অথচ তাকে হাতিয়ার করে বাঙালিবিরোধী বাঙালিবিদ্বেষ ছড়ানোয় এ দেশের বাঙালিদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা দেশের জাতীয় সংহতিকেই চ্যালেঞ্জ করার সামিল। এতে প্রত্যক্ষভাবে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বাংলার লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক। আমি যে জেলায় এখন বাস করি সেই দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত জেলা পুরুলিয়ার ত্রিশ শতাংশের বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করে থাকে। চারটি মহকুমার কুড়িটি ব্লকে বিন্যস্ত জেলাটি প্রাকৃতিকভাবেই অহল্যাভূমি, কৃষিকাজে প্রতিকূল। শিল্পেরও পর্যাপ্ত বিস্তার ঘটেনি। সেক্ষেত্রে বাড়ির সচ্ছলতার জন্য বাড়তি আয়ের উদ্দেশে গ্রামীণ পুরুলিয়া থেকে অসংখ্য জেলাবাসী পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র থেকে পাশ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড, ওড়িশায় পাড়ি দেন। সেখানে নির্মাণ শিল্পেই অধিকাংশ শ্রমিক জড়িত।

    এছাড়া কলকারখানা, হোটেল-রেস্তরাঁ থেকে রাস্তা তৈরির কাজে বছরের অধিকাংশ দিন চলে যায়। সেক্ষেত্রে বাড়তি আয়ের উৎসই এখন বন্ধ হওয়ার মুখে। সেদিক থেকে বাংলা বললেই বাংলাদেশি চিহ্নিত করে নির্যাতন থেকে আটক, শেষে পুশব্যাক করে বাংলাদেশে পাঠানোর ভয়ঙ্কর পরিণতি পরিযায়ী শ্রমিকের কাছে হাতে মারার সঙ্গে ভাতে মারার প্রাণসংশয়ী আয়োজন কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ জেলার পরিযায়ী শ্রমিকের মুখেও সেই ‘বাংলাদেশি’ আতঙ্কের ছায়া ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬১-এর ১ নভেম্বর বিহারের মানভূম জেলা থেকে ১৬টি ব্লকের বাংলাভাষীরা পুরুলিয়া জেলার অধিবাসী হয়েছিলেন। দেশের ভাষা আন্দোলনেও এই জেলার ভূমিকা আজও সমুজ্জ্বল। সেক্ষেত্রে পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিককে বাংলাদেশি বলা শুধু মিথ্যাচারই নয়, অপরাধও। বহুভাষাভাষীর ভারতে বাঙালিবিদ্বেষী আবহ যাতে আরও বিস্তার লাভ না করে, এজন্য কেন্দ্রীয় সরকারের আশু পদক্ষেপ জরুরি। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বিতাড়নের অজুহাতে দেশের অসংখ্য বাংলাভাষী মানুষকে অবিশ্বাস থেকে অস্বীকার করা শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করবে না, সেই সুযোগে বিচ্ছিন্নতাবাদী অপশক্তিও মাথাচাড়া দেবে। এজন্য রাজনৈতিক স্বার্থপূরণ অছিলায় বাঙালির সর্বস্বান্ত করে অস্তিত্ব বিপন্ন করার বিরুদ্ধে দলমতনির্বিশেষে তীব্র প্রতিবাদ জরুরি মনে করি।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)