অর্ণব আইচ: আহত হওয়ার পরও আর জি কর কাণ্ডে নির্যাতিতা তরুণীর মাকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে কেন প্রায় আধ কিলোমিটার পথ হাঁটানো হল? তারপর আরও প্রায় একঘণ্টা তাঁকে কেন বসিয়ে রাখা হল রাস্তায়? কেনই বা ঢিলছোড়া দূরত্বের এসএসকেএম হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে নির্যাতিতার মা ও বাবাকে খিদিরপুর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার নাম করে নিয়ে গেলেন বিজেপি নেতারা? শনিবারের বিজেপির ঝান্ডাহীন নবান্ন অভিযান ও তাকে নিয়ে নানবিধ চিত্রনাট্য দেখে এমনই প্রশ্নমালা তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
শনিবার নবান্ন অভিযান চলাকালীন পার্ক স্ট্রিটে কপালে আঘাত লেগে নির্যাতিতার মা আহত হন বলে অভিযোগ। নবান্ন অভিযান নিয়ে তদন্ত শুরুর পর পুলিশের পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তার ভিত্তিতে খোঁজখবর নেওয়াও শুরু হয়েছে। পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, এমন কোনও ফুটেজ মেলেনি যাতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ নির্যাতিতার মাকে আঘাত করছে। বরং আন্দোলনের নামে ধাক্কাধাক্কির সময় কোনওভাবে বিজেপির নেতা ও কর্মীদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ড বা পতাকার আহত পুলিশকর্মীদের দেখতে ডান্ডার আঘাতে তিনি আহত হন, এমন সম্ভাবনাই দেখছে পুলিশ। আবার গন্ডগোলের সময় পিছন থেকে বিজেপির কোনও নেতা বা কর্মীর ধাক্কায় গার্ডরেলে তাঁর মাথা ঠুকে যায়, এমন সম্ভাবনাও পুলিশ উড়িয়ে দিচ্ছে না।
শনিবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত বা ঘটনাবলির উপর নজরদারি রাখা বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে যে, বিজেপির মূল লক্ষ্য ছিল নির্যাতিতার মা ও বাবাকে সামনে রেখে প্রচার করা। সে কারণেই নির্যাতিতার মা আহত হয়েছেন ও তাঁর কপালে আঘাত লেগেছে। আহত মাকে কেন হাঁটানো হল? এই প্রশ্নের পাশাপাশি তিনি আহত হওয়ার পরও কেন বিজেপি নেতা-কর্মীরা তাঁকে কোনও হাসপাতালেই নিয়ে যাননি বা প্রাথমিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেননি, তাও সন্দেহের। উলটে অভিযোগ উঠেছে যে, কৌস্তভ বাগচী ও অন্য কয়েকজন বিজেপি নেতা ও কর্মী ওই অবস্থায় নির্যাতিতার মা ও বাবাকে প্রথমে পার্ক স্ট্রিট থেকে গাড়ি করে ফোর্ট উইলিয়ামের সাউথ গেটের কাছে নিয়ে যান। আহত বলে দাবি করার পরও সেখান থেকে তাঁরা নির্যাতিতার মাকে খিদিরপুর রোড ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যান। নবান্ন অভিযান উপলক্ষে সেখানে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল পুলিশ। সেখানে প্রখর রোদে রাস্তার উপর নির্যাতিতার মা ও বাবাকে প্রায় একঘন্টা বসিয়ে রাখে বিজেপি।
এরপর ফের গাড়ি করেই কৌস্তভ বাগচী তাঁদের নিয়ে যান বাইপাসের কাছে বেসরকারি হাসপাতালে। হাতের কাছে এসএসকেএম থাকলেও তাঁরা চিকিৎসার জন্য কেন নিয়ে যাননি, পুলিশ এমন প্রশ্নও তুলছে। শনিবার নবান্ন অভিযানের নামে বিজেপির ‘তাণ্ডবে’ আহত হয়েছেন পাঁচ পুলিশকর্মী ও আধিকারিকও। রবিবার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি পুলিশকর্মী প্রশান্ত পোদ্দারকে দেখতে যান পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা। নির্যাতিতার মা তাঁকে পুলিশ মারধর করছে বলে যে অভিযোগ তুলেছেন, সেই প্রসঙ্গে প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ কমিশনার জানান, এটা পুলিশের তদন্তের অংশ। এই ব্যাপারে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। নির্যাতিতার মা যে আহত হয়েছেন, তা অভিপ্রেত নয়। কিন্তু কী কারণে এরকম হল, সত্যিই পুলিশ তাঁকে আঘাত করেছে কি না, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কথায়, অভিযোগ করলে তদন্ত করা তো হবেই। কিন্তু অভিযোগ না পেলেও পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে। তবে এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
এদিন এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, “গতকাল পুলিশ অভয়ার মাকে কোনওরকম আঘাত করেনি। বিজেপি দায়িত্বজ্ঞানহীন পরিকল্পিতভাবে মা-বাবাকে সামনে নিয়ে গিয়েছে। আমি আগেই বলেছিলাম, ওরা নানারকম অভিযোগ এবং নাটক করবে। এত ক্যামেরা, এত চ্যানেল, এত চিত্র সাংবাদিক, এত সোশাল মিডিয়া- একটা ছবি কেউ পেলেন না, যেখানে সব ক্যামেরা তাঁদের দিকেই তাক করা ছিল।” কুণালের প্রশ্ন, “এর আগেও তো ওঁরা অনেক মিছিলে গিয়েছেন। হঠাৎ বিজেপির মিছিলে গিয়ে আহত হলেন কেন? এর আগে অভয়া মঞ্চ প্রশ্নটা তুলেছে।”
কুণালের অভিযোগ, “ওঁরা মেয়েকে হারিয়েছেন। ওঁদের প্রতি পূর্ণ সহমর্মিতা আছে। কিন্তু ওঁদের ব্যবহার করা হচ্ছে। নিজে ছবি তুলবে বলে ‘ন্যাড়া নাড়ু’ নির্যাতিতার মাকে ধাক্কা মারছে। একটা কোনও ছবি পাওয়া যায়নি, যেখানে পুলিশ আঘাত করেছে বা অসম্মান করেছে। আমাদের আমন্ত্রণে যদি মা-বাবা যেতেন, আমরা তাঁদের বুক দিয়ে আগলে রাখতাম। ছবি তুলিয়ে সেটা দিয়ে প্রচার পেতে যেতাম না। নিকৃষ্টতম রাজনীতি। কাল পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। কোনও প্ররোচনায় তারা পা দেয়নি। পুলিশ অসংযত হয়নি। পুলিশ অত্যন্ত সংযত ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশ আক্রান্ত হলেও কখনওই পাল্টা আঘাত করেনি।” নির্যাতিতার মাকে হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে কুণাল ঘোষ বলেন, “হাসপাতাল শনিবারই তাঁকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, সেই খবর আমাদের কাছে আছে। কিন্তু বিজেপির এক শীর্ষ নেতা অনুরোধ করেন, ওঁকে ভর্তি রাখার জন্য। বিজেপির কোনও নাটক নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়।”