‘মা বলেছিলেন হয় গান, নয় বিয়ে, এখন অসুস্থ হলে চিন্তা তো হয়ই’, গান থেকে জীবন, অকপট শ্রাবণী
আনন্দবাজার | ১১ আগস্ট ২০২৫
তাঁর কণ্ঠ যেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের আধার। কোনও বিশেষ ভঙ্গি ছাড়াই স্বরলিপি বজায় রেখে গান তিনি। তাঁর নিত্যযাপন জুড়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই প্রমাণ মেলে শিল্পীর বসার ঘরে। রবীন্দ্রনাথ ও মায়ের ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন বাড়ি। তবে সাজের আতিশয্য নেই নিজের। বর্ষাপীড়িত শ্রাবণ-সকালে গান নিয়ে আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে কথা বললেন শ্রাবণী সেন। তাঁর এক পাশে রাখা মায়ের ছবি, আর এক পাশে রক্তচাপ মাপার যন্ত্র।
প্রশ্ন: গান নিয়ে কেমন আছেন?
শ্রাবণী: দিব্যি চলে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আছি। আর অন্য কোনও গান গাই না। সব রকমের অনুভূতি আমি রবীন্দ্রনাথের গান থেকেই পেয়েছি। তাই অন্য গান গাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করিনি।
প্রশ্ন: এক সময় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী’রা ছিলেন, এখন কি আর শুধু রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী হওয়া যায়?
শ্রাবণী: আমি তো বলব, এখনও সম্ভব। আমাকে মানুষ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী’ হিসেবেই চেনেন। আমিও সেটাই চাই। মানুষ যেন আমাকে কেবল ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী’ হিসেবেই চেনেন। আসলে আমার থেকে শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই জায়গায় অন্য কেউ হয়তো রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক, নজরুলগীতি, এমনকি গজ়লও গেয়ে দেবেন।
প্রশ্ন: সকলে সব রকম গান গাইলে যাঁরা নির্দিষ্ট ঘরানার গান গাইছেন, তাঁদের অসুবিধা হচ্ছে, তাই না?
শ্রাবণী: এটা একটা সমস্যা তো বটেই। আগে প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ‘জ্যঁর’ ছিল। এখানে ‘বাজেট’ও একটা বিষয়। আমি হয়তো চার টাকায় শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছি। সেই জায়গায় অন্য কেউ এক টাকায় সব রকমের গান গাইছেন। কিন্তু তা-ও তো দেখেছি, মানুষ মন দিয়ে শুধুই রবীন্দ্রনাথের গান শুনছেন। তাঁদের দিক থেকেও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ারই অনুরোধ আসছে।
প্রশ্ন: এখন অনেকই স্বরলিপি মেনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেন না। ইউটিউব দেখেও গান তুলে নেন। তাঁরা আপনাদের প্রজন্মের শিল্পীদের গান ‘রেফারেন্স’ হিসাবে ব্যবহার করছেন। সব শিল্পীর কি এই বিশ্বাসযোগ্যতাটা রয়েছে?
শ্রাবণী: এটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা যেমন মায়েদের (সুমিত্রা সেন) গানের ধরন অনুসরণ করেছি। এই সময়ে যেমন স্বাগতাদি (স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত) একটা ভাল কাজ করেছেন। ওঁর ‘একলা গীতবিতান’-এ সমস্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত রয়েছে। ‘রেফারেন্স’ হিসাবে সেটা খুবই সুবিধাজনক। কিন্তু এখন তো অনেকেই স্বরলিপি মেনে গান না। না জেনেই হয়তো ভুলটা গেয়ে ফেলেন।
প্রশ্ন: তা হলে বিশ্বভারতীর স্বত্বাধিকার উঠে যাওয়া কি ঠিক হয়েছিল?
শ্রাবণী: বিশ্বভারতীর মতো কিছু একটা তো থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়। ধারাবাহিকে দেখি, প্রায়ই ভুল কথা বা সুরে গান গাওয়া হচ্ছে। সেই ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার মতো যেন কেউ থাকেন। ৩৫ বছর ধরে গান গাইছি। রবীন্দ্রনাথের গান তাই ভুল গাইলে ভাল লাগে না।
প্রশ্ন: এখন তো বাসস্টপ, রক্তদান শিবির অথবা পাড়ার মোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজে। সত্যিই কি সকলে বুঝছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত?
শ্রাবণী: রবীন্দ্রনাথের গান বাণীপ্রধান। যেমন সুর, তেমন কথা। শুধু সুরকে প্রাধান্য দিলে অনেক কিছু বাদ চলে যায়। মাইকে যে গান বাজতে থাকে, তা সেই ভাবে অনুধাবন করা যায় না ঠিকই। গাড়িতে যেতে হয়তো কানে এল কোনও গান। সুরটা কিন্তু কানে থেকে যায়। জানা গান হলে স্বাভাবিক ভাবেই আমরা তার পর গুনগুন করতে থাকি। এই হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের ম্যাজিক।
প্রশ্ন: ভুল স্বরলিপিতে গাওয়া গান ছবিতে ব্যবহারের কারণে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, শ্রোতারা জানতেই পারেননি কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক...
শ্রাবণী: হ্যাঁ। এ জন্যই সঙ্গীত পরিচালকদের আর একটু সতর্ক হওয়া উচিত। প্রয়োজন হলে আমরা যারা বুড়োবুড়ির দল (হেসে), তাঁদের একটু জিজ্ঞাসা করে নেওয়া উচিত। এখন তো একটা গান শোনার বিভিন্ন মঞ্চ। ঠিক গানটা শুনিয়ে নিলেই হয়ে যায়।
প্রশ্ন: সবটাই কি তবে উদাসীনতা?
শ্রাবণী: আসলে মানুষের সময় নেই। ‘গান গাইব’ মনে হল, সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতায়োজন করিয়ে রেকর্ডিংও হয়ে গেল। রাতের মধ্যেই গান তৈরি, ভিডিয়োও হয়ে গেল। পর ফেসবুক বা ইউটিউবে এসে হাজির। ভুল শুধরানোর সময়টুকুও নেই।
প্রশ্ন: খারাপ লাগে না?
শ্রাবণী: খারাপ তো লাগবেই। খারাপ লাগে। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান তো টেলিভিশনে বা বেতারে এখন হয় না বললেই চলে।
প্রশ্ন: অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমে গিয়েছে। আগের মতো অডিয়ো সংস্থা থেকে ক্যাসেট-সিডির চল নেই। তাতে অসুবিধা হয় না?
শ্রাবণী: অসুবিধা তো হয়ই। তবে এখন আমি গান শেখানোয় বেশি মন দিয়েছি। আগে অনুষ্ঠান থাকত, ছাত্রছাত্রীদের সময় দিতে পারতাম না। এখন আমি নিজেও কম অনুষ্ঠান করি। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ করি।
প্রশ্ন: কী রকম?
শ্রাবণী: প্রত্যেকেই খুব প্রতিভাবান, ভাল গায়। আমার কাছে তারা শিখছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কিন্তু ফেসবুক বা ইউটিউবে সব রকমের গান গাইছে। সেই গানগুলি খারাপ? আমি তা বলছি না। কিন্তু যে গান নিয়ে ওরা চর্চা করছে, সেটাই ওরা করছে না। এটা সমস্যা। আমরা এখন পণ্য হয়ে গিয়েছি। টাকা খরচ করলে, একবারে নানা রকমের গান শোনা গেলেই যেন প্রাপ্তি। অথচ মায়েদের সময়ে অন্য রকম বিষয় দেখেছি। আমার মা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নজরুলগীতি, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও উৎপলা সেন আধুনিক, নির্মলেন্দু চৌধুরী লোকগীতি। প্রত্যেকের ভিন্ন জ্যঁর ছিল। সেই ভাবেই মানুষ চিনত।
প্রশ্ন: কেন সব রকম গান গাইতে চাইছেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা?
শ্রাবণী: হয়তো ওঁরা ভাবছেন, সব রকমের গান গাইলে মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছোনো যাবে। কিন্তু, প্রথমে তো নিজেকে তৈরি করতে হবে। শ্রোতারাই তো আসল বিচারক।
প্রশ্ন: স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত বা লোপামুদ্রা মিত্রেরাও তো নানা ধরনের গান গান। আপনি কেন গাইলেন না?
শ্রাবণী: আসলে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনও গান পারি না। চেষ্টাও করা হয়নি সেই ভাবে। তবে শুধুই রবীন্দ্রসঙ্গীতে মনোজ-মনীষা রয়েছেন। পরের প্রজন্মেও বহু প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছেন। আমার চেয়ে তাঁরা অনেক ভাল গাইতে পারেন। আমার তো গান গাওয়ারই কথা ছিল না।
প্রশ্ন: তা হলে?
শ্রাবণী: আমার জীবনটাই অন্য রকম। আমি ভূগোলে স্নাতকোত্তর করেছিলাম। তার পরে সাংবাদিকতাও করেছি কয়েক দিন। একটি পত্রিকায় ফ্যাশন থেকে সঙ্গীত— নানা বিষয়ে লিখেছি। কিন্তু এক দিন সংস্থাটাই উঠে গেল। তার পরে গানে চলে এলাম। রক্তে থাকলে যা হয়।
প্রশ্ন: মায়ের থেকে কী কী গ্রহণ করেছেন?
শ্রাবণী: কোনও ভঙ্গি ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে— এটা শিখেছি মায়ের থেকে। আরও একটা বিষয় শিখেছি— সময় মতো গান গাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। অবসর নিতে হবে। অযথা জায়গা আটকে রেখে লাভ নেই। সেই জায়গায় নতুন কেউ সুযোগ পাক। মা নিজে বেতারে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘আমাকে আর গান গাইতে বলবেন না। সেই জায়গায় পরের প্রজন্মের শিল্পীদের সুযোগ দিন।’ আমি আমার যন্ত্রানুষঙ্গী ভাইদের বলে রেখেছি, যে দিন মনে হবে সেই দিনই যেন ওরা বলে, ‘দিদি আর তোমার দ্বারা গান হচ্ছে না’। আমি সেই দিনই অবসর নিয়ে নেব। শুধুই গান শেখাব তখন।
প্রশ্ন: আর দিদির থেকে কী কী শিখেছেন?
শ্রাবণী: দিদি আমার চেয়ে দশ বছরের বড়। ওর সঙ্গে অনুষ্ঠানে যেতাম। কী ভাবে মাইক্রোফোন ব্যবহার করছে, মাইক্রোফোন থেকে কতটা দূরে রাখছে, সেগুলো খুব মন দিয়ে দেখতাম। মায়া সেন আমার গুরু। ওঁর থেকেও বহু কিছু শিখেছি। আর বাবার কথা বলতেই হয়। বাবা নিজে গাইতেন না। তবে তাঁর জন্যই আমাদের পরিবারে এমন গানের পরিবেশ বজায় থেকেছে। বাবা কত গানের রেকর্ড আনতেন। বাড়িতে গানের আসর বসত, কত নামী শিল্পীরা আসতেন!
প্রশ্ন: দিদির সঙ্গে এখন দেখা হলে একসঙ্গে গান বাজনা করেন?
শ্রাবণী: না না, দেখা হলেই আমরা সিনেমা নিয়ে আড্ডা দিই। শাহরুখ খান, অমিতাভ বচ্চনদের গল্প করি। খেতে যাই। আবার পিএনপিসিও করি (হাসি)।
প্রশ্ন: পরিবারের এই ধারা বজায় রাখা, খুব বড় দায়িত্ব বলে মনে হয়?
শ্রাবণী: হ্যাঁ দায়িত্ব তো বটেই। আমি একাকী। আমার পরে এই দায়িত্ব বহন করার ভার আমার ছাত্রছাত্রীদের উপরে। আমি কিন্তু ওদের থেকেও বহু কিছু শিখি। ওরা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লেখাপড়াও করে। ওরাও কিন্তু প্রয়োজনে বলে দেয়, গানের কোন জায়গায় বেশি দম নেওয়া প্রয়োজন বা ইত্যাদি। আমি ওদেরকে সেই জায়গা দিই। ওরা আমার শুধু ছাত্রছাত্রী নয়। ওরাই আমার বন্ধু। একসঙ্গে আমরা ছবি দেখি, খেতে যাই। ওরাই আমার জীবন ধরে রেখেছে।
প্রশ্ন: পরিবারের জন্য তো তুলনার শিকারও হতে হয়.. তাই না?
শ্রাবণী: সেই তুলনা আজও হয়। সুমিত্রা সেনের কন্যা হিসেবে হয়তো ‘ফ্রি-এন্ট্রি’ পাওয়া গিয়েছে। তবে সেই মান রাখতে কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে। যদিও আজও আমাকে ও দিদিকে শুনতে হয়, ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে গানটি ঠিক মায়ের মতো হল না’। আমার লড়াইটা কিন্তু বেশি। দিদি যেমন খুব মন দিয়ে গান শিখেছে, সাধনা করেছে। ও খুব আত্মবিশ্বাসী। আমি তো সেই ভাবে শিখিনি। কিন্তু আমি জানতাম— মা বা দিদির নাম ভাঙিয়ে খাব না। একজন সাধারণ মানুষ যে ভাবে লড়াই করে ওঠেন, সেটাই করব।
প্রশ্ন: আপনি বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আমরা কী পারি বা পারি না, সেটা জানা প্রয়োজন।
শ্রাবণী: হ্যাঁ, নিজে কতটুকু পারি জানা দরকার। গান গাওয়ার ক্ষেত্রে নিজের সীমা জানতে হবে।
প্রশ্ন: আপনার সীমা (লিমিটেশনস্) কী কী?
শ্রাবণী: আমার বহু না পারা রয়েছে। প্রথমত, আমি রোগের আগার। মাথা থেকে পা পর্যন্ত রোগ। মাঝে মাঝেই কুপোকাত হই। তার পর আবার উঠে দাঁড়াই। এই সবের জন্য আমার গলার রেঞ্জ নিচুর দিকে। খুব উঁচু স্কেলে আমি গাইতে পারি না। চেহারাও ভারী। দমও নেই। এগুলো মাথায় রেখেই কিন্তু আমি গানের নির্বাচন করি। এগুলো জানলে গান গাইতে সুবিধেই হয়।
প্রশ্ন: নিয়মিত রেওয়াজ করেন এখনও?
শ্রাবণী: আমার প্রবল থাইরয়েড। খুব রেওয়াজ করলে আমার গলা ভেঙে যেতে পারে। কিছু দিন আগেই রবীন্দ্রসদনে একক অনুষ্ঠান করেছি। টানা তিন ঘণ্টা মানুষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলেন। সেখানেও কিন্তু খুব উঁচু স্কেলের গান নির্বাচন করিনি। এমনিতেও আমি ফাঁকিবাজ। এখন আমার কাছে রেওয়াজ বলতে শুধুই গান শেখানো। শেখাতে শেখাতেই শিখি। গানের মননেও বদল এসেছে। আমার ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু কড়া সমালোচক। ভুল হলে ওরাই ধরিয়ে দেয়।
প্রশ্ন: একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। একা কেন থেকে গেলেন?
শ্রাবণী: একা থাকার সিদ্ধান্তের পিছনে অনেক কিছু রয়েছে। মা একটা সময়ে বলেছিলেন, ‘হয় তুমি বিয়ে করো, না হয় তুমি গানটা করো।’ সঙ্গীতজগতে আসলে সময়ের কোনও ঠিক থাকে না। দূরে অনুষ্ঠান থাকলে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। ঘুম পর্যন্ত হয় না। বিপুল ব্যস্ততা থাকে। এমন জীবনযাপনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো মানুষ খুব কম আছে। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। আমার দিদির স্বামী, অর্থাৎ জামাইবাবু যেমন ভীষণ ভাবে পাশে থেকেছেন। দিদির শাশুড়ি নিজেই বলেন, ‘তুমি গান গাইতে যাও। আমি সবটা সামলে নিচ্ছি।’ ওর ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। তার পর স্নাতক, স্নাতকোত্তর, গবেষণার কাজ— সব করেছে। তার পাশাপাশি গান।
প্রশ্ন: এই দেখেও অনুপ্রাণিত হননি?
শ্রাবণী: কারণ, উল্টোটাও রয়েছে। আমার ছাত্রীদেরই দেখেছি। ভাল গান জানা মেয়ে দেখে বিয়ে হয়েছে। পরে আর তাঁকে গানটাই করতে দেওয়া হয়নি। কতটা কষ্টের এই অনুভূতি। গান তো সকলে গাইতে পারে না। এ তো ঈশ্বরের দান। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভাল আছি।
প্রশ্ন: অসুস্থতার সময়ে একা লাগে না?
শ্রাবণী: হ্যাঁ, অসুস্থ হলে একটু চিন্তা তো হয়। কিন্তু আমার যাঁরা গৃহকর্ম সহায়িকা রয়েছেন, তাঁরা খুবই ভাল। ওঁরা আমার ভাইবোনের মতো। দিদিও কাছে থাকে। সমস্যা হলে ও চলে আসে, অথবা আমি ওর কাছে চলে যাই।
প্রশ্ন: এই একাকিত্বে রবীন্দ্রনাথ কতটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন?
শ্রাবণী: একটা কথা বলি। আমাকে দেখে হয়তো মনে হয়, আমি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক কিছু জানি। কিন্তু আমি তেমন পড়াশোনা করিনি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গান আমার সঙ্গে থেকেছে। অল্প যেটুকু পড়েছি, তাতে মাটিতে পা রেখে চলতে শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
প্রশ্ন: যেমন?
শ্রাবণী: এই তো কিছু দিন আগেই বহু দিনের পরিচিত একজনের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল। সে চিৎকার করে গেল। আমি অতি শান্ত কণ্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। এটা রবীন্দ্রনাথের থেকে পাওয়া। রবীন্দ্রনাথকে বন্ধুর মতোও পাই আমি। কখনও ভেঙে পড়লে মনে হয়, পাশে কেউ তো আছে।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ। এই বিষয়ে নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। আপনার কী মত?
শ্রাবনী: বিশ্বভারতীর স্বত্বাধিকার উঠে যাওয়ার পরে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়। সঙ্গীতায়োজন নিয়ে অবশ্যই করা যায় পরীক্ষানিরীক্ষা। তা ছাড়া আর কিছু নিয়ে নয়। প্রথম দিকে জয় সরকারের সঙ্গে, প্রত্যুষের সঙ্গে কাজ করেছি। আমিও ছক ভেঙে, গিটার বা কি-বোর্ডের সঙ্গে গেয়েছি। মা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন, গোঁড়া লোকেরা কী বলবেন তা নিয়ে! তবে আমাদের মধ্যে পরিমিতি বোধ ছিল। দমাদ্দম ড্রাম বাজিয়ে গান গাইনি। কতটা পরীক্ষা করা যাবে, সেটা জানতে হবে।
শ্রাবণী: আমি কিন্তু মাচায় প্রচুর অনুষ্ঠান করেছি। কাকদ্বীপে একটি মাঠে অনুষ্ঠান করেছিলাম। শ্রোতাদের অধিকাংশই কৃষক। তাঁরা চট পেতে সামনে বসেছিলেন। জায়গাটা কিন্তু সাংঘাতিক। কটাক্ষ ধেয়ে আসতে পারে, এমন আশঙ্কাও ছিল। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে টানা ৪০ মিনিট সকলে মন দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছিলেন। অনুরোধও এসেছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতেরই। আমি মাচায় গান গাইতে ভালবাসি। এটা একটা চ্যালেঞ্জের মতো।
প্রশ্ন: এখন তো গান গাওয়ার পাশাপাশি নিজেকে মঞ্চে উপস্থাপন করাও একটা বিষয়। যার মধ্যে সাজ একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকেন। আপনি সাজেন না কেন?
শ্রাবণী: আমার সাজতে ভাল লাগে না। তাই পর পর অনুষ্ঠান হলে খুব ভেঙে পড়ি। রোজ শাড়ি পরা, কাজল পরা, টিপ পরা খুব কষ্টকর। এটুকুই সাজ আমার। বিয়েবাড়ি থেকে অনুষ্ঠান বা যে কোনও জায়গাতেই একই সাজ আমার। গরমের সময়ে তো আমি শুধু কোটা শাড়ি পরি। দিদি খুব সাজতে ভালবাসে। আমি চাই, আমার গানটাই যেন মানুষকে আকর্ষণ করে। বেশি সাজলে আমি গানটাই গাইতে পারব না। বেশি ভারী রংবেরঙের শাড়ি আমার পরতে ভাল লাগে না।
প্রশ্ন: ছাত্রছাত্রীদের গান নিয়ে এগোনোর জন্য কী পরামর্শ দেন?
শ্রাবণী: প্রথমেই বলি, কোথাও নিজে পয়সা দিয়ে গান গাইতে যেয়ো না। আমি নিজে কোনও দিন এটা করিনি। একদম পছন্দ করি না। আমাকে কিন্তু গান শুনে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
প্রশ্ন: কিন্তু আজ তো প্রতিযোগিতা তুঙ্গে। তা হলে এখন গান নিয়ে এগোনোর পথটা কী?
শ্রাবণী: এখন একমাত্র পথ ফেসবুক ও ইউটিউব। তবে সেখানে গুণমানের দিকে নজর রাখতে হবে।
প্রশ্ন: নিজের ছাত্রছাত্রীদের গানের সুযোগ পেতে কী ভাবে সাহায্য করেন?
শ্রাবণী: আমি আসলে নিজে কোনও দিন নিজের হয়ে বলতে পারিনি। তাই ওদের সুযোগ দেওয়া হোক, এটাও বলতে পারি না। সেই জন্য ভাবতাম, ওদের জন্য কী করা যায়। ঠিক করলাম, আমার গানের অ্যাকাডেমিতে ওরাই গান শেখাবে। আমার ১৮ জন সিনিয়র ছাত্রছাত্রী এখন আমার অ্যাকাডেমিতেই গান শেখায়। ওরা এখন আমার থেকেও ভাল শিখিয়ে দেয়।
প্রশ্ন: ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’ ছবিতে ‘অমল ধবল পালে লেগেছে’ গেয়ে সম্মানিত হয়েছিলেন। বাংলা ছবিতে এখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার হচ্ছে। আপনি প্লে-ব্যাকে সে ভাবে কাজ করছেন না কেন?
শ্রাবণী: করছি তো। সংখ্যায় হয়তো কমেছে। এই তো কিছু দিন আগেই সপ্তাশ্ব বসুর পরিচালনায় অঞ্জন দত্ত ও মমতাশঙ্কর অভিনীত ছবিতে গাইলাম ‘গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’।