• জেলায় চাষ হবে রাঁধুনিপাগল ধান
    আনন্দবাজার | ১০ আগস্ট ২০২৫
  • সে নাকি এমনই আশ্চর্য চাল যার সুগন্ধে পাগল হয়ে যেত রাঁধুনি নিজেই। লোকে বলত ‘হরিণ পাগল হয় নিজ নাভি গন্ধে, রসবতী পাগল হয় ভাত রান্ধার গন্ধে।’ প্রবাদের সেই ধান এ বার নদিয়ার মাটিতে ফলবে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নদিয়া জেলা কৃষি দফতরের যৌথ উদ্যোগে সদ্য জিআই তকমা পাওয়া রাঁধুনিপাগল ধান চাষে বাড়ছে আগ্রহ।

    সাধারণ ধানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি লাভজনক সুগন্ধি চাল রাঁধুনি-পাগল নিয়ে প্রবাদ নিছক কথার কথা নয়। এর প্রমাণ মেলে দেশ-বিদেশের পণ্ডিতদের লেখায়। প্রাচীন বঙ্গদেশে বহু প্রজাতির দেশীয় ধানের চাষ হত। তার মধ্যে সুগন্ধি ধানের কদর ছিল বেশি। ১৮৭৫ সালে ডবলু ডবলু হান্টার লিখিত ‘আ স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থে সুন্দরবন, ২৪ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলে চাষ হওয়া ৯৯ রকম ধানের তালিকার ২৭ নম্বরে আছে রাঁধুনিপাগল ধানের উল্লেখ। দেড়শো বছর আগেকার বাংলার সুগন্ধি ধান হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই ধান। এত দিন পরে আবার সেই ধান ঘিরে তৎপরতা কেন?

    জবাবে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্যবিজ্ঞানের শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ বলেন, “সুপ্রাচীন কাল থেকে এই সব ধান বাংলার নিজস্ব সম্পদ বলে বিবেচিত হত। কিন্ত সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, উচ্চ ফলনশীল বীজ নির্ভর কৃষিপ্রযুক্তি আসার পরে বাংলার ওই সব দেশীয় ধান চাষ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘসময় পরে এখন আবার নতুন করে ফিরছে হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধি ধান।” প্রসঙ্গত, তাঁর তত্ত্বাবধানেই নদিয়ায় সুগন্ধি ধান চাষের প্রকল্পরূপায়িত হচ্ছে।

    জানা গিয়েছে, রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার অধীনে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলার সুগন্ধি ধান’ প্রকল্পে কাজ শুরু করে উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে সঙ্গে নিয়ে। ইতিমধ্যে তাঁরা রাঁধুনিপাগল-সহ বেশ কয়েকটি হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধি ধানের জাত নিবন্ধীকরণ বা ‘রেজিস্ট্রেশন’ করিয়েছেন। গোবিন্দভোগ, তুলাইপাঞ্জি, কালো নুনিয়ার পরে গত মার্চ মাসে রাঁধুনি-পাগল বাংলার চতুর্থ সুগন্ধি ধান হিসাবে ‘জিআই’ তকমা পেয়েছে। জেলা কৃষি দফতরের সঙ্গে যৌথ ভাবে রাঁধুনিপাগলকে ফের মাঠে ফেরানোর কাজ অবশ্য তার অনেক আগেই শুরু হয়েছে।

    কৃষি দফতরের আধিকারিকদের কথায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলেছে। উৎসব অনুষ্ঠানে পোলাও, বিরিয়ানি বা বিভিন্ন রকম ‘রাইস’ খাওয়ার প্রবণতা অস্বাভাবিক বেড়েছে। ফলে, বাজারে সুগন্ধি চালের চাহিদা আকাশছোঁয়া। এই জায়গা থেকে কৃষকেরা সুগন্ধি ধান চাষে আর্থিক দিক থেকে দ্বিগুণ লাভবান হবেন। তাই আগ্রহ বাড়ছে ওই সব প্রজাতির ধান চাষে।

    এই প্রসঙ্গে নদিয়ার উপ কৃষি অধিকর্তা (বিশ্বব্যাঙ্ক প্রকল্প) অনুপম মজুমদার বলেন, “সুগন্ধি ধানের মধ্যে গোবিন্দভোগের বাজার দুর্দান্ত। বিশেষ করে বর্ধমানে প্রচুর পরিমাণে চাষ হচ্ছে। উত্তরবঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে তুলাইপাঞ্জির চাষ হচ্ছে। এতে চাষিরা আর্থিক লাভের মুখ দেখছেন। এই সব দেশীয় ধানের রোগ কম হয়। উৎপাদন বেশি। ফলে চাষিরা অচিরেইলাভবান হবেন।”

    ১৮৯১ সালে ডবলু ডবলু ওয়াটের ‘আ ডিকশনারি অফ ইকনোমিক প্রোডাক্টস অফ ইন্ডিয়া’ বইয়ে চার রকম সুগন্ধি ধানের উল্লেখ আছে। যার মধ্যে রাঁধুনিপাগল অন্যতম। এ ছাড়া, ভারতীয় কৃষি গবেষকদের লেখায় বারে বারে পাওয়া গিয়েছে ওই ধানের উল্লেখ। ১৯০১ সালে নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় বা ষাটের দশকে বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ প্রমুখ রাঁধুনিপাগলের কথা বলেছেন। সেই ধান নদিয়ার খেতে উৎপন্ন হওয়া সময়ের অপেক্ষা, এমনটাই দাবি বিশেষজ্ঞদের। যা নাকি জেলার ধান অর্থনীতির রং বদলেদিতে পারে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)