• অবহেলায় পড়ে বঙ্গভঙ্গ ও রাখিবন্ধনের ইতিহাস, বাগবাজারের বসুবাটি ভরেছে আগাছার জঙ্গলে
    বর্তমান | ১০ আগস্ট ২০২৫
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: শ্যামবাজারের পাঁচ মাথা ছাড়িয়ে টালার দিকে এগলে বাঁদিকে বাগবাজার স্ট্রিট। রাস্তাটি সোজা গিয়েছে গঙ্গা পর্যন্ত। সেই পথেই পড়ে ‘বসুবাটি’। বাগবাজার স্ট্রিটে ডানদিকে চোখ রাখলে একটি পথ নির্দেশিকা চোখে পড়ে। নির্দেশিকা অনুযায়ী, গলি দিয়ে ঢুকে সোজা এগলে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পুরনো একটি অট্টালিকা। আগাছার জঙ্গল, একের পর এক থামে লতাপাতা জড়িয়ে। বিশাল বাড়িটি দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়।

    বর্তমানে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি অস্মিতা নিয়ে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। এ সময় নতুন করে মনে পড়ে রাখিবন্ধন উৎসবের কথা। এই উৎসবের সঙ্গে বসুবাটির দীর্ঘ যোগসূত্র। শনিবার, রাখির দিন বাগবাজার গিয়ে দেখা গিয়েছে, ঐতিহাসিক বাড়িটির চেহারা কঙ্কালসার। দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়েছে গাছের শিকড়। উঁচু বিশাল থামগুলোর মাথায় সিংহের মূর্তি। তবে সর্বত্র মাকড়সার জাল, ধুলো।

    বাগবাজারের কাঁটাপুকুর এলাকার বসু পরিবার মূলত হাওড়ার দেউলপুর থেকে এসেছিল। কাঁটাপুকুর বসু পরিবারের একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন জগৎ চন্দ্র, যাঁর দুই পুত্র মাধব চন্দ্র এবং তারা চাঁদ। মাধব চন্দ্রের আবার তিন পুত্র, মহেন্দ্রনাথ, নন্দলাল এবং পশুপতি। মহেন্দ্রনাথের চেষ্টায় এই পরিবার বিশাল সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে, তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর ভাই নন্দলাল এবং পশুপতি বসু এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় ১৮৭৬ সালের ১৯ অক্টোবর। পরিবারটি ১৮৭৮ সালের ১০ জুলাই বসবাস শুরু করে। প্রথম বাঙালি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নীলমণি মিত্র প্রাসাদের নকশা ও নির্মাণ করেছিলেন। তিনি প্রচলিত ইউরোপীয় স্থাপত্য থেকে সরে এসে বাংলা ও ইসলামিক শৈলী থেকে অনুপ্রেরণা নেন বাড়ি বানাতে। শিল্পী বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু চিত্রকর্ম বসুবাটির দেওয়ালে সাজানো ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কেন্দ্রস্থল ছিল এই বাড়ি। নন্দলাল বসু ধার্মিক ছিলেন। তাঁর কারণেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং আরও কয়েকজন আধ্যাত্মিক নেতা এই বাড়িতে আসতেন। পশুপতি বসু শিল্প ও থিয়েটার ভালোবাসতেন এবং অনেক নাট্যকার এবং অভিনেতাও আসতেন। জানা যায়, ওয়াজিদ আলি শাহ এই বাড়িতে বসে গিরিশ ঘোষের নাটক দেখেছিলেন। 

    বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং রাখি বন্ধন উৎসবের সঙ্গে যোগসূত্র ছিল এই বাড়ির। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতায় এক বিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই মিছিলটি শিয়ালদহ থেকে বেরিয়ে শেষ হয় বসুবাটিতে। গোটা পথে সাধারণ মানুষের হাতে রাখি পড়িয়ে উৎসব পালন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ও বাংলার শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশে সেদিনই রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে এই বাড়িতে তৈরি হয়েছিল ন্যাশনাল ফান্ড। তারপর গঙ্গা গিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় পশুপতি নাথের বংশধররা ১৯৫৬ সালে প্রাসাদের পূর্ব অংশ পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে হস্তান্তর করে। ১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কলকাতা পুরসভা এই বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করে। বাড়িতে বসানো ফলকের গায়ে এই তথ্য লেখা। সে ফলক এখন আবছা। জানা যায়, বাড়িটির পশ্চিম অংশ ২০০৭-’০৮ সালে অম্বুজা রিয়েলটি কিনে নেয়। এখানে একটি ঐতিহ্যবাহী হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। তবে বেশ কিছু আইনি জটিলতায় এখনও সে কাজে কোনও অগ্রগতি হয়নি। প্রাসাদটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। নিরাপত্তারক্ষী থাকেন। বাংলার অনেক গৌরবময় ঘটনা বহুদিন আগলে রাখার পরও বিশাল প্রাসাদটি সময়ের সঙ্গে এগচ্ছে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে। জঞ্জালে ঢাকা পড়ছে বাংলার এর গৌরবময় ইতিহাস। -নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)