• পুলিশি প্রাচীরে দফায় দফায় থমকাল ‘নবান্ন অভিযান’, মধ্য কলকাতা দীর্ঘক্ষণ স্তব্ধ হলেও ইপ্সিত ফল পেল না বিজেপি
    আনন্দবাজার | ০৯ আগস্ট ২০২৫
  • ‘আনুষ্ঠানিক আহ্বান’ ছিল আরজি করের নির্যাতিতার মা-বাবার তরফে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে এটা প্রত্যাশিতই ছিল যে, ‘নবান্ন অভিযান’ পর্যবসিত হবে বিজেপির কর্মসূচিতে। বাস্তবেও তেমনই হয়েছে। কিন্তু দিনের শেষে ইপ্সিত ফল পায়নি রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল।

    ‘নবান্ন অভিযান’ রুখতে ধর্মতলা, শিয়ালদহ এবং সাঁতরাগাছি থেকে নবান্নমুখী সব রাস্তায় দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করেছিল পুলিশ। ফলে গত বছর ‘ছাত্র সমাজ’-এর নামে ডাকা অভিযান যেমন নবান্নের কাছাকাছি পৌঁছেছিল, এ বার তেমন হয়নি। তবে কলকাতা-হাওড়া দুই শহরেরই প্রাণকেন্দ্র প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থেকেছে।

    শুক্রবার সন্ধ্যায় জানা গিয়েছিল, বিজেপির তরফে থেকে কর্মসূচিতে যোগদানকারী কর্মী-সমর্থকদের তিনটি জায়গায় জড়ো হতে বলা হয়েছে— শিয়ালদহ, ধর্মতলা এবং সাঁতরাগাছি। এই তিন এলাকা থেকেই মিছিল নবান্ন অভিমুখে রওনা দেবে বলে পুলিশ ধরে নিয়েছিল। কারণ, অভিযানকারীদের তরফে সরকারি ভাবে পুলিশকে কোনও ‘রুট’ জানানো হয়নি। নবান্নের চারপাশে অনেকটা এলাকায় ১৬৩ ধারা জারি থাকায় সেখানে মিছিল নিয়ে যাওয়া বেআইনি বলে শুক্রবারেই পুলিশ জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞা যে আন্দোলনকারীরা মানতে চাইবেন না, তা-ও প্রত্যাশিতই ছিল। ফলে ধর্মতলা থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর দিকে যাওয়ার সব বড় রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড খাড়া করা হয়। শিয়ালদহ থেকে কোনও মিছিল রওনা হলে যাতে গঙ্গা পেরোতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হাওড়া ব্রিজের মুখেও বিরাট ব্যারিকেড তৈরি হয়। সাঁতরাগাছিতেও জমায়েতের আধ কিলোমিটার দূরেই রাস্তা আটকে দেওয়া হয়।

    তবে বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ প্রথম উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে সাঁতরাগাছির দিকেই। ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। শিয়ালদহ থেকে কোনও বড় জমায়েত বা গোলমালের খবর মেলেনি। বরং শিয়ালদহ থেকে মিছিল হলে যে দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেই হাওড়া ব্রিজের আশপাশেই বিক্ষিপ্ত ভাবে ভিড় বাড়তে শুরু করে। কলকাতায় সবচেয়ে বড় জমায়েত হয়েছিল ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং তথা রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে। বেলা ১টা সেই জমায়েত দু’ভাগে হয়ে একটা অংশ ডোরিনা ক্রসিংয়ে অবস্থান শুরু করে। অন্য অংশটি মিছিল করে হেস্টিংসের দিকে রওনা হয়। সেখান থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে নবান্নের দিকে যাওয়া যায়।

    ধর্মতলা থেকে রওনা দেওয়া ওই মিছিলেই ছিলেন নির্যাতিতার মা-বাবা। তাঁদের সঙ্গে প্রথমে ছিলেন বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল, জোয়েল মুর্মু, আশিস বিশ্বাসেরা। পরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং শঙ্কর ঘোষ, সুব্রত ঠাকুর, অশোক দিন্দা, নীলাদ্রিশেখর দানা-সহ একঝাঁক বিধায়ক মিছিলটিতে যোগ দেন। প্রায় শুরুতেই এক পাশের রাস্তায় ব্যারিকেড করে মিছিলকে উল্টো দিকের লেনে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। জওহরলাল নেহরু রোডের উড়ালপুলের র‌্যাম্পেও পুলিশ মোতায়েন ছিল, যাতে মিছিল উড়ালপুলে উঠতে না পারে। উড়ালপুলের ডান পাশের রাস্তা ধরে মিছিল এগোতে থাকে। পার্ক স্ট্রিট মোড়ের কয়েকশো মিটার আগেই বড় ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে দিয়েছিল পুলিশ। জনা দশেক বিজেপি কর্মী মিছিলের আগে ছুটে গিয়ে প্রথমে ব্যারিকেডে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেন। পিছনের মিছিল ব্যারিকেড পর্যন্ত পৌঁছলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে বুঝে পুলিশও তৎপরতা বাড়াতে শুরু করে। কিন্তু মিছিলটি আচমকা লেন বদলে যাদুঘরের দিকের রাস্তায় চলে যায়। তার পরে দ্রুত এগনোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিড স্ট্রিটের মুখেই আবার আটকে যায় পুলিশের ব্যারিকেডে।

    ততক্ষণে নির্যাতিতার মা-বাবার পাশে শুভেন্দু চলে এসেছেন। ব্যারিকেড ভেঙে এগনোর জোরদার চেষ্টা শুরু হয়। মিনিট দশেকের ধস্তাধস্তিতে ব্যারিকেডের একটি অংশ আলগা হয়ে যায়। সেই ফাঁক দিয়ে নির্যাতিতার মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে জনা ত্রিশেক আন্দোলনকারী এগিয়ে যান। কিন্তু শুভেন্দু-সহ বিজেপি বিধায়করা বেরনোর আগেই পুলিশ আবার ব্যারিকেড জুড়ে দেয়। ফলে শুভেন্দুর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত দু’জনকে পাশে নিয়ে এগোতে থাকেন নির্যাতিতার মা-বাবা।

    সেই পর্বের ধস্তাধস্তিতেই নির্যাতিতার মা জখম হন। তাঁর কপালের এক পাশে ফুলে যায়। এক হাতের শাঁখাও ভেঙে যায়। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশের লাঠির ঘায়েই তিনি জখম হয়েছেন। পুলিশ অবশ্য জানায়, হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে তিনি আঘাত পেয়েছেন।

    জখম অবস্থাতেই তাঁরা হেস্টিংস মোড়ের দিকে যাওয়ার রাস্তা ধরেন। দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে ওঠার র‌্যাম্প যেখানে শুরু হয়েছে, তার কিছু আগে ত্রিস্তরীয় ব্যারিকেড এবং কন্টেনার দিয়ে গোটা রাস্তা আটকে রেখেছিল পুলিশ। মাত্র জনা ত্রিশেক সঙ্গীকে নিয়ে সে ব্যারিকেড ভাঙা বা টপকানো নির্যাতিতার মা-বাবার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অগত্যা তাঁরা ব্যারিকেডেই উঠে পড়েন। সেই অবস্থাতে কিছুক্ষণ প্রতিবাদ জানান। তার পরে সেখানেই অবস্থানে বসে পড়েন। নির্যাতিতার মা জখম হয়েছেন বলে জানার পরেই পার্ক স্ট্রিট মোড়ের কাছে ততক্ষণে অবস্থান শুরু করে দিয়েছেন শুভেন্দুরা।

    অবস্থানে বসে নির্যাতিতার মা অসুস্থ বোধ করায় বেলা ৩টের কিছু পরে তাঁকে নিয়ে বিজেপি নেতা-কর্মীরা রওনা হন বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতালের পথে। ফলে ওই অবস্থানটি তখনই উঠে যায়। পার্ক স্ট্রিট মোড়ের কাছে শুভেন্দু অবস্থান প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন বিকেল ৪টের কিছু আগে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা জুনিয়র চিকিৎসকদেরও এই কর্মসূচিতে ডেকেছিলাম। তাঁরা আসেননি। কিন্তু তাঁরা বিকেলে কালীঘাট অভিযানের ডাক দিয়েছেন। সেই কর্মসূচি যাতে সফল হয়, তার জন্য আমরা এখানে অবস্থান প্রত্যাহার করছি।’’

    পরে নির্যাতিতার মাকে দেখতে হাসপাতালে যান শুভেন্দু। সেখান থেকে বেরিয়ে জানান, ওই হাসপাতালে মোট ছয় আন্দোলনকারী চিকিৎসাধীন। কাউন্সিলর সজল ঘোষের হাসপাতালে এবং রেলের হাসপাতালে ১৫-১৬ জন চিকিৎসাধীন বলেও তিনি দাবি করেন। ধর্মতলায় যাঁরা অবস্থান করছিলেন, বিনা প্ররোচনায় পুলিশ তাঁদের উপরে দফায় দফায় লাঠি চালিয়েছে বলে বিজেপি অভিযোগ করে। পাল্টা ধর্মতলা চত্বরে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের একটি অফিসে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ ওঠে বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধেও।

    সকলে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিলে যোগ দিলেও শনিবারের নবান্ন অভিযান মূলত বিজেপি-র কর্মসূচিরই চেহারা নিয়েছিল। তবে ওই কর্মসূচিতে বিজেপিকে ‘সাবধানী’ দেখিয়েছে। আন্দোলনও ‘নির্বিষ’ মনে হয়েছে। মধ্য কলকাতা এবং হাওড়ার কিছু অংশের প্রায় সব রাস্তাঘাট বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত স্তব্ধ রাখতে পারলেও ২০২৪ সালে ‘ছাত্র সমাজে’র নামে ডাকা নবান্ন অভিযানের মতো ধুন্ধুমার ছবি দেখা যায়নি কলকাতা-হাওড়ায়। জলকামান-সহ কোনও ‘শক্তি’ ব্যবহার করতে হয়নি জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে। তবে লাঠি চালাতে হয়েছে পুলিশকে। যদিও তাতে আহতের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

    সাধারণত কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করে কিছু ‘সূচক’-এর উপর। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গোলমাল, ধস্তাধস্তি বা হিংসাত্মক ঘটনার ঘনঘটা। বিক্ষিপ্ত কিছু বচসা বা ধস্তাধস্তি ছাড়া শনিবারের ‘নবান্ন অভিযান’ মোটের উপর শান্তিপূর্ণই ছিল। যে অভিঘাত ঘটানোর আশা বিজেপি করেছিল, তা হয়নি। যদিও পদ্মশিবিরের নেতারা তা মানতে নারাজ। অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের মতোই তাঁরাও বলছেন, অভিযান ‘সফল’।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)