নবজাগরণ-এর প্রতিষ্ঠা দিবস, সংবর্ধিত ব্রাত্য বসু-ঝুলন গোস্বামী
আজকাল | ০৯ আগস্ট ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: রসায়নবিদ, দেশপ্রেমিক, বাংলায় শিল্প স্থাপনের জনক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিন ২ আগস্ট। বাঙালি মননে-জীবনে তাঁর প্রভাব কতখানি, তা আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন রাখে না। নব চেতনার উন্মেষের দিকপালের জন্মদিনটিকেই তাই বেছে নেওয়া হয়েছিল, আর এক নতুন সূচনার জন্য। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিনে, অর্থাৎ ২রা আগস্ট, ১৯৯৯, পথচলা শুরু করেছিল 'নবজাগরণ'। প্রায় তিন দশক ধরে পথ হাঁটছে, নতুন চেতনার জাগরণে।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি 'নবজাগরণ'-এর জন্মদিন উপলক্ষে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন বিগত বছরগুলিতেও। অন্যথা হয়নি এবারেও। নবজাগরণ-এর প্রতিষ্ঠা দিবসে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শুভেচ্ছা বার্তায় লিখেছেন, ‘বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে কলকতার শিশির মঞ্চে আগামী ২ আগস্ট, ২০২৫, ‘নবজাগরণ’-এর প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হবে জেনে আনন্দিত হলাম। এই দিনটি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়-এর জন্মদিবস। বাঙালিকে বিজ্ঞানসচেতন ও বাণিজ্যমুখী করে তুলতে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর আদর্শকে পাথেয় করেই বাংলা ও বাঙালির শিল্প-বাণিজ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া জগৎকে আরও সমৃদ্ধ করতে ‘নবজাগরণ’ কাজ করে চলেছে। প্রতিষ্ঠা দিবসের প্রাক্কালে 'নবজাগরণ'-এর সকল সদস্যকে আমার অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই এবং অনুষ্ঠানের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি। বাংলার নবজাগরণ আমাদের ইতিহাসের এক গর্বজনক স্থানে অধিষ্ঠিত। মানুষকে আরও বেশি করে বিশেষ করে নবপ্রজন্মকে এ সম্বন্ধে আরও বেশি করে সচেতন করে তুলতে হবে।‘ মুখ্যমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বার্তা উপস্থিত দর্শকের সামনে পড়ে শোনান নবজাগরণ-এর অন্যতম কর্ণধার, টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটির আচার্য সত্যম রায়চৌধুরী। একইসঙ্গে তিনি নিজেও শুভেচ্ছা বার্তা দেন।
নবজাগরণ-এর সাধারণ সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত উপস্থিত থাকতে পারেননি এদিনের অনুষ্ঠানে। তাঁর শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও, মনে প্রাণে প্রতিটি মুহূর্তে তিনি যে অনুষ্ঠানের মধ্যেই ছিলেন, তা বলা বাহুল্য। সকলের সামনে, সশরীরে হাজির হতে না পারলেও, বার্তা পাঠিয়েছিলেন তিনি। সেই বার্তাও পড়ে শোনানো হয়। আজকাল-এর সম্পাদক তাঁর শুভেচ্ছা বার্তা লিখেছেন, ‘এবার নবজাগরণ-এর ২৭ তম প্রতিষ্ঠা দিবস। নতুন প্রজন্ম দায়িত্ব নিচ্ছেন, আশা করি, আমাদের সক্রিয়তা আরও বাড়বে।আজ আমরা সংবর্ধনা জানাচ্ছি ব্রাত্য বসুকে। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি দক্ষ, সৎ, নিষ্ঠাবান। এই সংবর্ধনার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। সংবর্ধনা জানাচ্ছি, বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্য-ব্যক্তিত্বকে। নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা। অলরাউন্ডার। গিরীশ ঘোষ, উৎপল দত্তের যোগ্য উত্তরসূরি। সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়, পরিচালনাও। আমরা বিশেষ করে নাটকের ব্রাত্য বসুকে সংবর্ধিত করছি।সংবর্ধনা জানাচ্ছি ঝুলন গোস্বামীকে। মেয়েদের ক্রিকেটে নিঃসন্দেহে সুপারস্টার। একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বরেকর্ড তাঁরই। যেদিন অবসর নেন, হরমনপ্রিতরা কেঁদেছিলেন ওঁদের ঝুলুদির জন্য। এই তো সেদিন, লর্ডসে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে অধিনায়ক হরমনপ্রিত কাউর, চনমনে জেমাইয়া রডিগ্রেজরা ফোনে আবেদন জানালেন, 'ঝুলুদি, ফিরে এসো।‘ চাকদা থেকে রোজ প্র্যাকটিস করতে আসতেন। নাম হল ‘চাকদা এক্সপ্রেস।' নাটক-প্রতিভা ব্রাত্য বসু ও ক্রিকেট নক্ষত্র ঝুলন গোস্বামীকে সংবর্ধনা জানাতে পেরে আমরা গর্বিত।স্বাগত জানাচ্ছি ‘বাংলার লাল' অরুণ লালকে, যিনি আমাদের সবার থেকে বেশি বাঙালি। শেষবার বাংলা রণজি চ্যাম্পিয়ন ১৯৯০ সালে। প্রধান স্থপতি অরুণ লাল। শুভ জন্মদিন অরুণ।‘
সম্পাদকের চিঠিতেই উল্লিখিত, নবজাগরণ চলতি বছরে সংবর্ধনা জানিয়েছে নাট্য ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা, লেখক একই সঙ্গে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে। উল্লেখ্য, অশোক দাশগুপ্ত তাঁর বার্তায় স্পষ্ট করেছেন, ‘আমরা বিশেষ করে নাটকের ব্রাত্য বসুকে সংবর্ধিত করছি।‘ তাঁকে সংবর্ধনা জানান নবজাগরণ-এর অন্যতম কর্ণধার, টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটির আচার্য সত্যম রায়চৌধুরী এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত। সংবর্ধনা জানানো হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার, বাংলার মেয়ে ঝুলন গোস্বামীকে। তাঁকে সংবর্ধনা জানান নবজাগরণ-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সমর নাগ এবং অরুণ লাল। এদিন অরুণ লালকেও সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয় নবজাগরণ-এর পক্ষ থেকে।
নবজাগরণের মঞ্চে ব্রাত্য বসু বললেন বাংলার কথা। বাংলা ভাষার কথা। বাঙালির কথা। ভিন রাজ্যে সাম্প্রতিককালে যে বারে বারে বাংলা ভাষা আক্রান্ত হচ্ছে, সেকথাও এদিন উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে তাঁর কথায় বারে বারে ফিরে এল ছোটবেলা, অশোক দাশগুপ্তর লেখা, খেলা পত্রিকা, এক ছুটে সেসব সংগ্রহ করে এক নিঃশ্বাসে সেসব গোগ্রাসে পড়ে ফেলার দিনের কথা। ব্রাত্য বসুর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি উঠে এল ঘুরে ফিরে। তিনি এক সুতোয় গাঁথলেন ১৯৯৯ সালে গড়ে ওঠা নবজাগরণ, মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আসার পরের ‘বিশ্ববাংলা’ এবং বর্তমানে নানা জায়গায় যখন বাংলাভাষা আক্রান্ত, তখন মমতার গর্জে ওঠা, আন্দোলনকে। বলেন, ১৯৯৯ সালের নবজাগরণ-এর ভাবনা, আর বর্তমান পরিস্থিতিতে মমতা ব্যানার্জির সার্বিক আন্দোলন বাংলার জন্য, বাঙালির জন্য, তা মোহনায় এসে মিলে যায়। কখনও তাঁর কথায় ১৯৪৭ সালের ইতিহাস, কখনও অখণ্ড সপ্নের কথা, আর কখনও এক ছুটে পৌঁছে যাওয়া ছোটবেলার। দর্শক কথায় কথায় হাততালি দিয়ে জানালেন সমর্থন, কখনও স্মৃতিমেদুর হলেন।
ঝুলন গোস্বামী। বাংলার মেয়ে, জগত জোড়া খ্যাতি। যাঁর লড়াই অনুপ্রেরণা বহু বহু মানুষের। খুব অল্প কথায় তিনিও যেন নবজাগরণ-এর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফিরে গেলেন ছোট বেলায়। ফিরে গেলেন, ‘খেলা’ ম্যাগাজিন খুঁটিয়ে পড়ার দিনে, জীবনের রসদ জোগাড় করার দিনে। সময়সরণি উল্লেখ করে শোনালেন, নিজের বড় হওয়ার কথা।
অরুণ লাল, বাংলার লাল। খাঁটি বাংলায় বললেন, এই রাজ্যের শিল্প, সংস্কৃতির কথা, বাংলায় তাঁর জীবন যাত্রার অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, জীবনের লড়াইয়ের কথা। অনুরাগীদের উদ্দেশে লাল বলেন, একজন মানুষকে ‘লড়াকু’ বলা হয়, কিন্তু কে কতটা লড়াই করবেন, করতে পারবে, সেটা পরিস্থিতি ঠিক করে দেয় আদতে।
সংবর্ধনা পর্ব যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনই চলতি বছরের নবজাগরণ-এর উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে থেকে যাবে গার্গী রায়চৌধুরীর পরিবেশনা। আলো, মঞ্চ, ক্যামেরার ওপারে তিনি সাবলীল, সেকথা কে না জানেন। তবে বহুদিন পর, গার্গী আবার এদিন সকলকে চমকে দিলেন, মুগ্ধ করলেন সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে। শুধু গান বললে ভুল বলা হয়, লালন থেকে রবীন্দ্রনাথ, হ্যারি বেলাফোন্টে, ‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/ সবই দেখি তা না না না…’ থেকে ‘ আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, আসলে গানগুলিকে গার্গী সাজিয়েছিলেন সংলাপের আকারে। সকলের সামনে তুলে ধরলেন যেন দীর্ঘপথের সেই কথোপকথনকেই। কেন এই ভাবনা, কীভাবে সাজিয়েছিলেন সমগ্র বিষয়টি? মুখে হাসি নিয়ে গার্গী জানালেন, ‘অশোক দাশগুপ্ত বলেছিলেন। আমি মনের আনন্দে করেছি। আমার গানের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। যেহেতু অনুষ্ঠান নবজাগরণ-এর। তার মূল সূত্র ধরেই আমি সাজিয়েছি গানগুলি।‘
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি সুর বাঁধেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী, রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। তালিকায় যেমন ‘বাংলায় গান গাই’, তেমনি মুখ্যমন্ত্রীর লেখা, সুর দেওয়া গানও। ইন্দ্রনীল যখন গাইলেন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর …’, দর্শকাসনে তখন ছড়িয়ে গিয়েছে প্রশান্তি, চোখে মুখে অপার মুগ্ধতা।