• অলৌকিক না কি বিজ্ঞান, পিটুইটারি গ্রন্থিবিহীন ১৯ বছর, হতবাক চিকিৎসাবিজ্ঞান!
    আজকাল | ০৯ আগস্ট ২০২৫
  • গোপাল সাহা

    কথায় বলে ‘রাখে হরি তো মারে কে’, যেমন কথা তেমনটাই কাজ। বয়স যখন ৪৫, তখন চিকিৎসা করতে গিয়ে জানতে পারে মাথায় মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘পিটুইটারি গ্রন্থি’ই নেই তাঁর। এমনটা দেখে চিকিৎসকরা পর্যন্ত হতবাক! কী করে সম্ভব? পিটুইটারি গ্রন্থি মানুষকে পরিচালনা করে এখান থেকে নির্গত হরমোন দ্বারা। এই গ্রন্থির অনুপস্থিতি মানুষের জীবনে বেঁচে থাকা প্রায় এক প্রকার অসম্ভব। আর এই ব্যক্তির পিটুইটারি গ্রন্থিটিই নেই! চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে এর কোনও ব্যাখ্যাই নেই! রহস্য উন্মোচিত হল ওই ব্যক্তির ৪৫ বছর বয়সে এসে। 

    উত্তরপাড়া মাখালার বাসিন্দা উত্তম নস্করের মস্তিষ্কে নেই পিটুইটারি গ্রন্থি। প্রখ্যাত এন্ড্রোক্রোনোলজিস্ট সত্যম চক্রবর্তী উত্তমের চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন আজ থেকে ১৯ বছর আগে তাঁকে সাপে কেটেছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, সর্পদংশনের কারণে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিভাবে এই গ্রন্থি ছাড়াই উত্তম ১৯ বছর বেঁচে রইলেন সেটাই বিস্ময়কর?

    কী ঘটেছিল এই উত্তম নস্করের জীবনে?

    ঘটনাটি ২০০৬ সালের। এই উত্তমের বয়স তখন ২৫ বা ২৬ বছর। দুর্ঘটনাবশত সাপে কামড়ায় তাঁকে। এরপর তাঁর বহু চিকিৎসা হয় এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আক্রান্ত হয় কিডনি এবং যার কারণে ছয় থেকে সাত বার তাঁর ডায়ালিসিস পর্যন্ত করতে হয়েছিল বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার। এর পর থেকেই উত্তমের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। একই সঙ্গে তাঁর শরীরের বেশ কিছু স্বাভাবিক বৃদ্ধি যেমন, চুল-দাড়ি পর্যন্ত লোপ পেতে শুরু করে। মাথার চুলের তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও তাঁর দাঁড়ি ওঠা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও লুপ্ত হয়ে যায় তাঁর যৌন ক্ষমতা। কারণ পিটুইটারি গ্রন্থি থেকেই টেস্টোস্টেরন হরমোন ক্ষরণ হয়। এমনকি তাঁর খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত সীমিত হয়ে যায়। এই ভাবেই কেটেছে ১৯ বছর।

    পিটুইটারি গ্রন্থি কী এবং এর গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা

    পিটুইটারি গ্রন্থি হল একটি ছোট, মটরদানার মতো আকারের হরমোন-নির্গতকারী গ্রন্থি। যা মস্তিষ্কের তলদেশে হাইপোথ্যালামাসের নীচে অবস্থিত। এটি হাইপোথ্যালামাসের সঙ্গে একটি স্নায়ু রেশা ও রক্তনালীর ডাঁটা দ্বারা সংযুক্ত। পিটুইটারি গ্রন্থিকে ‘মাস্টার গ্রন্থি’ বলা হয়। কারণ, এটি শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকা পালন করে হরমোন উৎপাদন ও নিঃসরণের মাধ্যমে।

    পিটুইটারি গ্রন্থি নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা

    ১. অবস্থান ও গঠন: পিটুইটারি গ্রন্থি একটি হাড়ের গঠন, যাকে সেলা টার্সিকা বলা হয়, তার ভিতরে বসে থাকে। এটি মাথার খুলির নীচের দিকে স্ফেনয়েড নামক হাড়ে একটি গহ্বরে থাকে। যা নাকের পিছনে অবস্থিত।

    এটি অপটিক কায়াজম (optic chiasm) এর নীচে অবস্থিত, যেখানে দু’টি চোখের স্নায়ু পরস্পরকে ক্রস করে। এটি ইন্টারনাল ক্যারোটিড আর্টারি নামক দু’টি প্রধান রক্তনালীর মাঝখানে থাকে।

    পিটুইটারি গ্রন্থি দু’টি প্রধান ভাগে বিভক্ত: অ্যান্টেরিয়র (সামনের) ও পোস্টেরিয়র (পিছনের) লোব। মানুষের ক্ষেত্রে ইন্টারমিডিয়েট লোব থাকলেও তা স্বতন্ত্র অংশ হিসেবে গঠিত নয়। অ্যান্টেরিয়র লোব অপেক্ষাকৃত বড় এবং পুরো গ্রন্থির প্রায় ৮০% ওজন ধারণ করে।

    ২. এই গ্রন্থির কার্যাবলী: পিটুইটারি গ্রন্থি স্নায়ুতন্ত্র ও অন্তঃস্রাবী তন্ত্রের মাঝে একটি সেতুবন্ধন রচনা করে। এটি হাইপোথ্যালামাস থেকে সংকেত পেয়ে বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণ করে, যা শরীরের অন্যান্য অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি ও অঙ্গের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এই হরমোনগুলোর প্রভাব পড়ে বৃদ্ধি, বিপাকক্রিয়া, রক্তচাপ, প্রজনন ক্ষমতা এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার উপর।

    পিটুইটারি গ্রন্থি যে গুরুত্বপূর্ণ হরমোনগুলি নিঃসরণ করে তার মধ্যে রয়েছে, গ্রোথ হরমোন (Growth Hormone or GH), থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (TSH), প্রোল্যাকটিন, ইত্যাদি। এই হরমোনগুলি থাইরয়েড, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি, ডিম্বাশয় এবং অণ্ডকোষের মতো অন্যান্য অন্তঃস্রাবী গ্রন্থিকে প্রভাবিত করে।

    ৩. পিটুইটারি গ্রন্থির সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ: পিটুইটারি গ্রন্থি হাইপোথ্যালামাসের সঙ্গে কার্যকরভাবে সংযুক্ত, যা হরমোন নিঃসরণের উপর নিয়ন্ত্রণকারী এক গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্কের অংশ। হাইপোথ্যালামাস, স্নায়ু ও রক্তনালীর মাধ্যমে পিটুইটারি গ্রন্থিকে সংকেত পাঠায়, যার প্রতিক্রিয়ায় পিটুইটারি নির্দিষ্ট হরমোন তৈরি ও নিঃসরণ করে। এই হরমোনগুলি তারপর রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে সারা শরীরে পৌঁছে নির্দিষ্ট অঙ্গ বা গ্রন্থির ওপর কাজ করে, শরীরের সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষা করে।

    পিটুইটারি গ্রন্থিবিহীন ১৯ বছর জীবন যুদ্ধের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে কী বলছে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিশেষজ্ঞরা

    আজ থেকে ১৯ বছর আগে উত্তমকে যে সাপে কেটেছিল সেটি হল চন্দ্রবোড়া সাপ যাকে বলে ভাইপারাইন স্নেক বাইট (হিমোটক্সিক স্নেক)। এই ধরনের সাপে কাটলে রক্ত জমাট বাঁধার পদ্ধতি নিজে থেকেই শুরু হয়ে যায়। আর যার ফলে রক্ত সঞ্চালনে বিভিন্ন বাধা আসে অর্থাৎ রক্তের মধ্যে ছোট ছোট জমাট বাঁধার পরিস্থিতি তৈরি হয় রক্তনালীগুলির মধ্যে। যেহেতু এই পিটুইটারি গ্রন্থির মধ্যে দিয়ে যে রক্তের সূক্ষ্ম নালিগুলি আছে সেগুলির মধ্যে নিউট্রিশনে বাধার সৃষ্টি হয় এবং নিউট্রিশন না পাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে এই পিটুইটারি গ্রন্থি শুকিয়ে যেতে যেতে অবলুপ্তি ঘটে। উত্তমের ক্ষেত্রে এমন ঘটনাই ঘটেছে সাপে কামড়ের ফলে। এই ধরনের সাপের কামড়ে মানবদেহে নানা ধরনের বিকৃতি বা সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। উত্তমের ক্ষেত্রে তাঁর সৌভাগ্য জীবিত থাকলেও, এ ধরনের ঘটনা সত্যি বিরল। বিজ্ঞানের ভাষায় এর কোন প্রকৃত ব্যাখ্যা নেই বললেই বলা যেতে পারে, বলেই বলছে চিকিৎসামহল। কারণ পিটুইটারি গ্রন্থিহীন হয়ে দেহের হরমোন নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা এক প্রকার অসম্ভব। এই জাতীয় সাপের দংশনে অবশ্যই এন্ড্রোক্রোনোলজিস্টের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। 

    আজকাল ডট ইন-এর মুখোমুখি হয়ে সত্যম বলেন, “উত্তমের ক্ষেত্রে বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক। কারণ, পিটুইটারি গ্রন্থিবিহীন কোনও ব্যক্তির এতদিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমি শুরুতেই চিকিৎসা করতে গিয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী কারণে এমন শারীরিক সমস্যা? পরে সিটি স্ক্যান করতে গিয়ে এবং কেস স্টাডি করতে গিয়ে তাঁর পরিবারের মুখে সবটা শুনে বুঝতে পারলাম এবং চিকিৎসা শুরু করি। খুব অল্প খরচে তাঁর শরীরে ঘাটতি থাকা হরমোন গুলি পুনঃস্থাপন করেছি। তবে তাঁকে বাকি জীবনও চিকিৎসাধীন থাকতে হবে, কারণ পিটুইটারি গ্রন্থি না থাকার কারণে শরীরের হরমোন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ব্যাহত। ওষুধের দ্বারা পুনঃস্থাপন এবং সেটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে অন্যথায় তাঁর জীবন সংশয় হতে পারে।”

    চিকিৎসক আরও বলেন, “উত্তম এখন ভাল আছে, এখন সে কর্মজীবনে ফিরেছে এবং তাঁর স্বাভাবিক জীবন শুরু হওয়ার কারণে বিয়ে করার ইচ্ছা পর্যন্ত প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে আমি খুবই আনন্দিত যে, তাকে তার সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি, ফিরিয়ে দিতে পেরেছি একটা সুন্দর আলোকিত জীবন, এই ভয়ানক কালো অন্ধকার জীবন থেকে বার করে। কারণ সাপে দংশনের পর চিকিৎসা শেষে একটা অন্ধকার জীবনে তলিয়ে গিয়েছিল। কোনও কাজই সে করত না, বাড়ির একটা কোনায় পরে থাকত, তার স্মৃতি পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছিল। পূর্বের কথা কিছুই মনে ছিল না। খাওয়া-দাওয়ার পরিমানও ছিল তার খুবই ন্যূনতম। ১৯ বছর পর চিকিৎসার কারণে আমার কাছে চিকিৎসার কারণে আসলে আমি আমার সেরা চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং ফিরিয়ে দিতে পেরেছি তাঁর একটা সুন্দর বর্ণময় জীবনে।”

    এ বিষয়ে উত্তম নস্কর বলেন, “আমার সৌভাগ্য যে ভগবান আমার সঙ্গে চিকিৎসক সত্যম চক্রবর্তীর মতো ডাক্তারের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর চিকিৎসায় আমি এখন যথেষ্ট ভাল আছি। কাজকর্ম করছি। চিকিৎসা চলছে, মাঝেমধ্যে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য। তবে, এখন যথেষ্টই ভাল আছি ডাক্তারবাবুর চিকিৎসার জন্য।”
  • Link to this news (আজকাল)