গ্রাম বাংলার স্কুল শিক্ষিকার জীবনের যুদ্ধ জয়ের উপাখ্যান! শ্রেয়সী হয়ে উঠল জয়ী
আজকাল | ০৯ আগস্ট ২০২৫
গোপাল সাহা: গ্রাম বাংলার শিক্ষিকার জীবন যুদ্ধের উপাখ্যান, ধন্বন্তরি চিকিৎসকের ছোঁয়ায় ফিরলো প্রাণ! বর্ধমানের এক গ্রামের শিক্ষিকা নাম শ্রেয়সী চ্যাটার্জি, সুস্থ জীবনে তার হঠাৎই নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া, বলাবাহুল্য এক দুরারোগ্য ব্যাধির কালো হাতছানি ঘিরে ধরে তার জীবনে। যে রোগের নাম শুনলেই যেন আমাদের জীবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে, যে রোগের নাম কদাচিৎ শোনা যায়, আর যার জীবনে আসে তছনছ করে দেয় তার জীবন ও পরিবারকে আর্থিক মানসিক ও শারীরিক সমস্ত দিক থেকে। নাম 'লিউপাস' (SLE)।
উল্লেখ্য, অটোইমিউন ডিজিজ (Autoimmune disease) এর মধ্যে অর্থাৎ আওতায় একাধিক রোগের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যেমন - ভিটিলিগো বা শ্বেতী, অ্যাজমা, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, SLE অর্থাৎ লিউপাস। আর এই অটো ইউনিয়ন ডিজিজের একটি ভয়ংকর রোগ লিউপাস এ আক্রান্ত হওয়ার কারণে শ্রেয়সীর জীবনেও নেমে আসে এক কালো ছায়া, রোগভোগের কারণে জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে হারাতে হয় তার বেসরকারি স্কুল শিক্ষিকার চাকরিটিও। তবে চিকিৎসক অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে সুস্থ জীবনের ফিরতে পেরেছেন শ্রেয়সী পরিবারের সঙ্গে।উল্লেখ্য, ২০২২ সালের এপ্রিলে বেশ কিছু সিমটম বা উপসর্গ লক্ষ্য করে তার শরীরে, সে নিয়েই চলছিল তার শিক্ষকতার জীবন। এরপর উপসর্গ এবং অসুস্থতা বাড়ার সাথে সাথে চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ এবং চিকিৎসার আওতায় থেকে বহু প্রচেষ্টার পর অবশেষে ডিসেম্বরে অর্থাৎ প্রায় নয় মাস বাদে এই রোগের নির্ধারণ করা যায় এবং শুরু হয় তার চিকিৎসা। কিন্তু চিকিৎসা চলাকালীন শরীর অসুস্থতার কারণে হারাতে হয় তার স্কুল শিক্ষিকার চাকরিটি। তবে চাকরি হারালেও ধন্বন্তরি চিকিৎসকের চিকিৎসার কারণে শ্রেয়সী হন জয়ী। অবশেষে প্রায় তিন বছর চিকিৎসার পর ২০২৫ এ তার সুস্থ জীবনে ফিরে আসা। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে এখনো তার চিকিৎসা চলবে বলেই জানিয়েছেন চিকিৎসক এবং শ্রেয়সী নিজেও।
এই রোগের কারণে উপসর্গ তেমন গভীরভাবে অথবা জোরালো কোনো উপসর্গ লক্ষণীয় নয়। তবে এই রোগে আক্রান্ত হলে যেটা সাধারণত লক্ষ্য করা যায় যেমন - চোখের জল শুকিয়ে যাওয়া, শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হওয়া, শরীরে বিভিন্ন রকম অস্বস্তি অনুভব, জ্বর হওয়া, পেটে জল জমে যাওয়া, বিভিন্ন অর্গান আক্রান্ত হয়ে পরা, ধার ও মাথায় ব্যথা হওয়া, অত্যাধিক পরিমাণে দুর্বল অনুভব করা, এই ধরনের কিছু উপসর্গ লক্ষ্য করা যায় এমনটাই বলছেন চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা।
বলা বাহুল্য, এ ধরনের কিছু উপসর্গ লক্ষ্য করা গিয়েছিল বর্ধমান নিবাসী তৎকালীন স্কুল শিক্ষিকা শ্রেয়সী র শরীরে। আর তারপরেই এ রোগের মূল উৎস খুঁজে পেতে বলা যায় চিকিৎসকদের মাথার ঘাম পায়ে পরে, নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। শ্রেয়সী জানিয়েছেন, বহু হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে রাজ্য সহ রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেও প্রথমদিকে থৈ পাচ্ছিলেন না এই রোগে আক্রান্ত শ্রেয়সী ও তার পরিবার এবং চিকিৎসকরা। রাজ্য তথা দেশে রিউমাটোলজিস্ট প্রখ্যাত চিকিৎসক একাধিক রয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন কলকাতার প্রখ্যাত চিকিৎসক অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়। যার সান্নিধ্য অর্থাৎ প্রখ্যাত রিমোটলজিস্ট চিকিৎসক অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য পেয়ে এই রোগকে জয়লাভ করেন শ্রেয়সী।
দেখে নেওয়া যাক এ ধরনের রোগের বিস্তারিত বিবরণ চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের মতে :
লিউপাস (lupus), বিশেষ করে সিস্টেমিক লিউপাস এরিথেমাটোসাস (SLE), একটি দীর্ঘমেয়াদী অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত নিজেরই টিস্যু ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রমণ করে। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ এবং ক্ষতি হতে পারে, যেমন ত্বক, অস্থি-সন্ধি (জয়েন্ট), কিডনি, মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অঙ্গ।
লিউপাস সম্পর্কে মূল বিষয়গুলো:
১. অটোইমিউন প্রকৃতি:রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সাধারণত যেভাবে সংক্রমণ মোকাবিলা করে, লিউপাসে সেটি ভুলভাবে শরীরের সুস্থ কোষ ও টিস্যুকে আক্রমণ করে।
২. দীর্ঘস্থায়ী রোগ:এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যার এখনও কোনো সম্পূর্ণ নিরাময় নেই, তবে উপসর্গগুলি ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পূর্বে শুধু স্টেরয়েড ওষুধের দ্বারাই চিকিৎসা হতো। তবে বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসায় স্টেরয়েড হীন ওষুধের দ্বারাই চিকিৎসা সম্ভব।
৩. বিস্তৃত উপসর্গ:লিউপাস শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমে প্রভাব ফেলে, তাই এর উপসর্গের ধরণও খুব বৈচিত্র্যময় হতে পারে।
* সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে:
* জয়েন্টে ব্যথা ও ফোলা
* অতিরিক্ত ক্লান্তিভাব
* ত্বকে র্যাশ (মুখে প্রজাপতি-আকৃতির র্যাশ হতে পারে)
* জ্বর
* সূর্যালোকের প্রতি সংবেদনশীলতা
৪. সম্ভাব্য জটিলতা:লুপাসের কারণে গুরুতর সমস্যাও হতে পারে, যেমন:
* কিডনির ক্ষতি (লুপাস নেফ্রাইটিস)
* স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা
* হৃদ্যন্ত্র ও রক্তনালীর রোগ
৫. নির্ণয়:উপসর্গগুলো অনেক সময় অন্যান্য রোগের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় লিউপাস নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে।
চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রাখা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি প্রতিরোধ করা। সাধারণত প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দমনকারী ও প্রদাহ কমানোর ওষুধ ব্যবহৃত হয়।
৬. ঝুঁকির কারণ:এর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি, তবে জেনেটিক (বংশগত) প্রবণতা, পরিবেশগত উপাদান এবং হরমোনজনিত পরিবর্তন—এই তিনটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এ রোগে আক্রান্ত বা যুদ্ধ জয়ী শ্রেয়সী কর আমাদের সংবাদ হয়ে মুখোমুখি হয়ে বলেন, "আমি ভাবতেই পারিনি আমার এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হবে এবং প্রথমে বুঝতে পারিনি আমার যে কোন রোগ হয়েছে বলে সেভাবে কোন উপসর্গ আমি অনুভব করিনি। তবে চোখের জল শুকিয়ে যাওয়া বা জ্বর হওয়া, মাথা ঘাড় যন্ত্রণা, পেটে জল জমা, এ ধরনের উপসর্গ কিছু লক্ষ্য করেছিলাম বা চিকিৎসকরা লক্ষ্য করেছিল। আমি জীবনে বেঁচে ফেরার আসাটাই ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারণ বহু চিকিৎসকদের সান্নিধ্যে আসা এবং তাদের চিকিৎসা করতে গিয়ে তারাও প্রচন্ড চিন্তায় পরে গিয়েছিলেন আমার সমস্যাগুলো দেখে"।
শ্রেয়সী তার রোগ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে আরও বলেন, "রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে চিকিৎসকরা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন আমার এই রোগ কে নিরাময় করতে। অবশেষে ভগবানের মত ধন্বন্তরি চিকিৎসক অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় আমার এই রোগ নিরাময় করেন। আজ তিনি না থাকলে হয়তো আমি আমার জীবনের মূল স্রোতে বা পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারতাম না। আমার অশেষ সৌভাগ্য যে আমি চিকিৎসক অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়ের চিকিৎসা পেয়েছি। বর্তমানে আমি সুস্থ রয়েছি এবং আর কিছুদিনের মধ্যেই আশা করব আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবো। সবটাই হয়েছে চিকিৎসক অর্ঘ চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। বর্তমানে আমাকে স্টেরয়েড মেডিসিন নিতে হয় না, স্টেরয়েড হীন ওষুধের দ্বারাই আমার চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেছি।"
আমাদের সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে সরাসরি কথা বলেছিলেন চিকিৎসক (রিউমেটোলজিস্ট) অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, তিনি বলেন, "এ রোগের প্রথমে উপসর্গ চোখের জল শুকিয়ে যাওয়া, চোখ মুখ শুকিয়ে যাওয়া, হাই ফিভার হওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি ভাব সহ বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ যা সাধারনত মানুষ লক্ষ্য করেনা। আমি বলব এই ধরনের সিমটম হলে অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং ঠিকমতো চিকিৎসা করানো। কোন অবস্থাতেই গাফিলতি না করা। এ ধরনের রোগের মূল কারণ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরের অন্দরেই নিজের অর্গান কে বা কোষগুলোকে ভুলবশত আক্রমণ বা আক্রান্ত করে বসে। ফলে এ ধরনের রোগের উৎপত্তি হয়। পূর্বে এই রোগের চিকিৎসা একমাত্র স্টেরয়েড ট্রিটমেন্ট বা চিকিৎসা ছিল। পূর্বে এই রোগের চিকিৎসা ঠিকমত না করা গেলেও বর্তমানে এ ধরনের রোগের চিকিৎসায় শুধু স্টেরয়েড নয় আধুনিক অনেক ওষুধ এসেছে যা সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব এবং সুস্থ জীবনে ফিরে আসা সম্ভব, যদি ঠিকমত রোগ নির্ধারণ করা যায় শুরুতেই।"