মৌমাছি কমছে, হচ্ছে না পরাগমিলন বাঁকুড়ায় কুমড়ো চাষ ছাড়ছেন কৃষকরা, উদ্বেগ
বর্তমান | ০৮ আগস্ট ২০২৫
উজ্জ্বল পাল, বিষ্ণুপুর: ছক্কা থেকে ঝোল। মাছের মাথা, ডাল, গোবিন্দভোগ সহযোগে মুড়িঘণ্ট। অথবা, পাঁচ মেশালি সব্জি হোক কিংবা নবরত্ন—বাঙালির হেঁশেল যেন কুমড়ো ছাড়া অচল! আর সেই কুমড়ো যদি হয় বাঁকুড়ার, তা হলে তো আর কথাই নেই। স্বাদে-পুষ্টিতে, সহজে সেদ্ধ হতে এই রুক্ষ জেলার পেট মোটা গোল সব্জিটির জুড়ি মেলা ভার। ফলে, বাংলার ঘরে ঘরে আলাদা একটা কদর পায় বাঁকুড়ার কুমড়ো। আবার মহোৎসব হোক কিংবা পিকনিকে রাঁধুনির ফর্দতেও লেখা থাকে—‘বাঁকুড়ার কুমড়ো হলে ভালো।’ কিন্তু, এবার কি সেই ব্র্যান্ড ইমেজ হারাতে চলেছে রাঙামাটির জেলা?
কৃষকরা মাঠে বীজ পুঁতছেন। গজিয়ে উঠছে গাছ। কিছুদিন পর লক লক করে বাড়ছে লতানো কাণ্ড। তাতে ঢাউস পাতা। ফুল ধরছে। ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু কুমড়োর গুঁটি আর ধরছে না! হতাশ চাষিরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারছেন, গুঁটি ধরানোর মূল কারিগর মৌমাছির দেখা নেই মাঠে। হচ্ছে না পুরুষ ফুলের সঙ্গে স্ত্রী ফুলের পরাগমিলন। তাই উৎপাদন কমতে কমতে একেবারে তলানিতে। এভাবে চললে খুব অচিরেই কুমড়ো উৎপাদনে গরিমা হারাবে বাঁকুড়া। উৎকণ্ঠায় জেলার কৃষক থেকে শুরু করে উদ্যানপালন দপ্তর। বর্তমানে কোনও কোনও চাষি ফুলে ফুল ঠেকিয়ে পরাগমিলন ঘটিয়ে ফলন বাড়ানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাতে সাফল্যের হার একরকম নেই বললেই চলে।
এখন গোটা বিশ্বে সবুজ বিপ্লবের ঝড়। উৎপাদন বাড়াতে অত্যধিক রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে। তার জেরেই মৌমাছির সংখ্যা ক্রমশ কমছে। বাস্তুতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রাকৃতিক উপায়ে পরাগমিলন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কুমড়োর ফুল। আর তাতেই উৎপাদন কমে যাচ্ছে বাঁকুড়ায়। হর্টিকালচার দপ্তরের বাঁকুড়া জেলা আধিকারিক পলাশ সাঁতরা বলছিলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। গোটা বিশ্বে মৌমাছির সংখ্যা কমে গিয়েছে। সচেতনমূলক প্রচার করা হচ্ছে। প্রতিবছর ওয়ার্ল্ড হানি ডে পালন করা হচ্ছে। পরাগ মিলন না হওয়ায় শুধু কুমড়ো নয়, পটল সহ অন্যান্য অনেক সব্জির উৎপাদন মার খাচ্ছে।’ সমস্যা মোকাবিলায় পলাশবাবু একটা পথও বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘পুরুষ ফুল তুলে তা কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে হবে। রেনু গুলো জলে মিশে যাওয়ার পর তাতে অল্প পরিমাণ চিনির দানা মিশিয়ে স্প্রে করলে অনেকটাই কাজ দেবে। আবার বুস্টার ফোর নামে একটি হরমোন ওষুধও প্রয়োগ করা যেতে পারে।’
জীববৈচিত্র রক্ষায় অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন পাত্রসায়রের বালসি উচ্চ বিদ্যালয়ের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক শুভাশিস পাল। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। তাতে মৌমাছি, মাকড়সা সহ বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ছে। যা আগামী দিনে বাস্তুতন্ত্রে বিরাট প্রভাব পড়বে। এনিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন।’
কী বলছেন বাঁকুড়ার কৃষকরা? তালডাংরার রাজপুর গ্রামের চাষি স্বরূপ পাল বলছিলেন, ‘বর্ষাকালীন কুমড়োর চাষে প্রতিবছর ভাল আয় হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করছি। গাছ সতেজ, পরিপুষ্ট। অথচ, ফল ধরছে না। আগে কুমড়োর ফুলে মৌমাছির দল ঘুরে বেড়াত। এখন সেই ছবি উধাও। আমরা পুরুষ ফুলের সঙ্গে স্ত্রী ফুল ঠেকিয়ে পরাগরেণুর মিলনের চেষ্টা করছি। তাতে খুব সামান্য ফলন হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ চাহিদা মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। ফলে, এলাকার অনেক চাষিই এখন কুমড়োর পরিবর্তে বিকল্প সব্জি চাষে ঝুঁকছেন।’ মৌমাছি ছাড়া বাঁকুড়ার কুমড়ো চাষে সত্যিই বড় দুঃসময়! ফাইল চিত্র