ভাষা-রক্ষার ডাক দিয়ে পথে নেমে ফের বিজেপিকে কড়া হুঁশিয়ারি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েক দিন আগে ‘বাংলাদেশি ভাষা’র কথা উল্লেখ করে দিল্লি পুলিশ বঙ্গ ভবনে চিঠি পাঠানোয় বিতর্ক বেধেছিল। প্রতিবাদ করেছিলেন মমতাও। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছিলেন বিজেপির আইটি শাখার প্রধান অমিত মালবীয়। ঝাড়গ্রামে ভাষা-মিছিল শেষে বুধবার মালবীয়ের নাম-না করেই মমতা পাল্টা বলেছেন, ‘‘একটা মালপোয়া! মালপোয়া খাই কখনও কখনও আমরা। মালপোয়া বলছেন, আমাকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা উচিত। কেন আমি বাংলা ভাষায় কথা বলেছি বলে? তোদের বুকের পাটা থাকলে কখন গ্রেফতার করবি, কখন গুলি করবি আয়!’’
এর আগে বোলপুরের মতোই ঝাড়গ্রামেও এ দিন মনীষীদের ছবি হাতে নিয়ে মিছিল করে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী মানুষের হেনস্থার প্রতিবাদ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ (ববি) হাকিমেরা। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘বাংলা ভাষায় কথা বললেই জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কোন ভাষায় কথা বলতেন? নেতাজি, বিবেকানন্দ কোন ভাষায় কথা বলতেন? জাতীয় সঙ্গীত কোন ভাষায় রচনা করা হয়েছিল? স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল বাংলা। বাংলা ছাড়া ভারতবর্ষ ও সারা বিশ্ব হয় না। নাসাতেও বাংলার ট্যালেন্ট (প্রতিভা) রয়েছে।’’
এরই পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, তিনি নিজে চাইলে তবেই তাঁকে সরানো সম্ভব! তাঁর কথায়, ‘‘বাংলায় থাকুন, শান্তিতে থাকুন। আমি যে দিন নিজে মনে করব, সে দিন আমাকে হটাতে পারবেন। আমি যত দিন নিজে মনে করব না, হটাতে পারবেন না! আপনার বিজেপির লোকেরা আমাকে ভোট দেবে। কারণ, তাদের ঠিকানা ও আশ্রয় চাই।’’ আগামী দিনে বিজেপির নেতারা বাংলায় এলে রাজ্য জুড়ে ধিক্কার মিছিলের কর্মসূচি নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এ বার প্রতিরোধ করার পালা!’’
নিজে চাইলে তবেই সরানো যাবে, এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘কেউ বলেছিলেন, সারদা দেবী মৃত্যুর পরে কালীঘাটে জন্ম নিয়েছেন। এখন বোঝা যাচ্ছে ভীষ্মের (মহাভারতে যাঁর স্বেছামৃত্যুর ক্ষমতা ছিল) আত্মাও মুক্তি পায়নি! এত দিন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। বহু শতাব্দী পরে তিনি একটি দেহ পেয়েছেন আশ্রয় নেওয়ার জন্য!’’
ভিন্ রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্থার প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা যখন ঝাড়গ্রামে মিছিল করছেন, সে দিনই বিজেপি-শাসিত হরিয়ানার পানিপথে গিয়ে বাঙালি শ্রমিকদের দুর্দশার কথা শুনেছেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী। পানিপথে কার্পেট ও বস্ত্রশিল্পে কর্মরত বাংলার শ্রমিকদের পুলিশি হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে, মারধরের চোটে কয়েক জনের পা ভেঙেছে বলে অভিযোগ। সেখানে গিয়ে অধীর বলেছেন, ‘‘বাংলাভাষী আর বাংলাদেশি গুলিয়ে দিয়ে অরাজকতা চলছে, অত্যাচার হচ্ছে। মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আপনারা ভয় পাবেন না। ভোটে হেরেছি কিন্তু হারিয়ে যাইনি! রাজ্য সরকার কুমীরের কান্না কাঁদছে! আপনাদের জন্য আমরা লড়ব।’’ পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার দাবিও তুলেছেন তিনি। পানিপথে এ দিন চার জায়গায় চারটি সভা করে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন অধীর। এ রাজ্যের কংগ্রেস নেতা আলি ইমরান রাম্জ (ভিক্টর), সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের পাশাপাশি পানিপথের কংগ্রেস নেতারাও সেখানে ছিলেন।
বাংলাভাষীদের হেনস্থা বন্ধে পদক্ষেপের আর্জি জানিয়ে হরিয়ানার নবনিযুক্ত রাজ্যপাল অসীম ঘোষকে চিঠি দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। বাংলায় লেখা চিঠিতে প্রদেশ সভাপতি বলেছেন, ‘হরিয়ানার মহামহিম রাজ্যপালের পাশাপাশি আপনি নিজেও এক জন বাঙালি। বাংলা ভাষার এবং বাঙালির সম্মান রক্ষায় আপনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি’।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ফের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) প্রসঙ্গও টেনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘কোচবিহারে অসম থেকে নোটিস পাঠাচ্ছেন। অসম থেকে বাংলায় নোটিস পাঠাতে পারেন না। এটা অপরাধ, অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক। ধিক্কার জানাচ্ছি!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমরা সবাই ভোটার। হঠাৎ করে বিজেপি জিততে ঠিক করেছে, নতুন করে ভোটারের নাম তুলতে হবে। এটা বিজেপির চালাকি। এর পিছনে এনআরসি-র চক্রান্ত রয়েছে। অসমে ৭ লক্ষ বাঙালির নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল, যাঁরা হিন্দু বাঙালি ছিল। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে নোটিস পাঠাচ্ছেন।’’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক অবশ্য বলেছেন, ‘‘উর্দুর বদলে বাংলার শিক্ষক চেয়ে রাজেশ, তাপসকে খুন হতে হয়েছিল। যে দলের মন্ত্রী বলেন, সেই দিন আর বেশি দেরি নেই, যে দিন পশ্চিমবঙ্গের ৫০% মানুষ উর্দুতে কথা বলবেন, যে কংগ্রেস সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে প্রতারণা করেছিল, সেই কংগ্রেসের গর্ভ থেকে যে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম, তাদের কাছ থেকে বাংলা প্রেম শিখতে হবে না!’’ বাংলাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’র তকমা দেওয়ার প্রতিবাদে বিজেপির বিভিন্ন দফতরে এ দিন থেকে ‘বর্ণ পরিচয়’ ও ‘সহজ পাঠ’ ক্যুরিয়র মারফত পাঠানো শুরু করেছে এসএফআই।