প্রদীপ চক্রবর্তী, কোন্নগর
সম্প্রতি কোন্নগর কানাইপুরের তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য পিন্টু চক্রবর্তীর খুনে হুগলি শিল্পাঞ্চলে ফিরে এসেছে বাম জমানার ত্রাসের স্মৃতি। নয়ের দশকের শেষ দিকে জমি বিক্রির টাকার বখরা নিয়ে গোলমাল ও খুনোখুনি ছিল শিল্পাঞ্চলে মস্তানরাজের চেনা ছবি। পিন্টুর খুনে কুখ্যাত দুষ্কৃতী ভোলানাথ দাস ওরফে বাঘার গ্রেপ্তারিতে সেই মস্তানরাজেরই ঝলক দেখছেন এলাকার অভিজ্ঞ বাসিন্দারা।
কলকাতার কাছে দিল্লি রোড ও জাতীয় সড়ক লাগোয়া হুগলির গ্রামীণ এলাকায় জমির দাম তুলনামূলক ভাবে কম। সেই কারণেই নানা ধরনের ক্ষুদ্রশিল্প স্থাপনের জন্য জমি নিয়ে বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
তাতেই জমির মালিক ও ব্যবসায়ীদের মাঝখানে মধ্যস্থতা করতে মাথাচাড়া দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। ব্যবসায়ীদের একলপ্তে পছন্দের জমি পাইয়ে দিতে জমির মালিকদের থেকে কখনও নিজেরা কখনও দালালের মাধ্যমে কম দামে জমি কিনে বেশি দামে বিক্রি করার রেওয়াজ চলছিল বাম জমানা থেকেই। তৃণমূল আমলে সেই প্রবণতা বেড়েছে বই কমেনি।
হুগলি শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে গঙ্গার উল্টো দিকের উত্তর ২৪ পরগনার দুষ্কৃতীদের যোগাযোগ অনেক দিনের হুগলি শিল্পাঞ্চলের ত্রাস শ্যামল দাস ওরফে হুব্বা শ্যামলের উত্থান কোন্নগর থেকেই।
বাম জমানায় রাজনৈতিক মদতে ঝড়ের গতিতে হুব্বার রমরমা বাড়তে থাকে। হাওড়া, হুগলি, কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনায় হুব্বার প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে চলে। ওই সময়ে কোন্নগর স্টেশনের পশ্চিম দিকে কানাইপুরের দুষ্কৃতী ভোলানাথ দাস ওরফে বাঘার সঙ্গে এলাকা দখল নিয়ে সংঘাত শুরু হয় হুব্বার। মূলত হুব্বার দাপটেই বাঘা কানাইপুর ছেড়ে গঙ্গার উল্টো দিকের নিমতায় গিয়ে থাকতে শুরু করে। বাঘার ভাই বিশাও নিমতা বেলঘরিয়ায় থাকত।
২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পর তৃণমূল ক্ষমতায় আসতেই জমি বিবাদের জেরে হুকব্বা শ্যামল খুন হয়ে যায়। হুব্বা খুনে নাম জড়ায় তারই ছায়াসঙ্গী হাওড়ার কুখ্যাত দুষ্কৃতী রমেশ মাহাতো, নেপু গিরির। হুব্বার খুনে রমেশ, নেপুরা দীর্ঘদিন জেলে ছিল।
তার পর থেকে হুগলি শিল্পাঞ্চলে বড় ধরনের খুন খারাপি বা গ্যাংস্টারদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়নি। কিন্তু গত সপ্তাহে কানাইপুরে তৃণমূল নেতা পিন্টু চক্রবর্তীকে ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে খুন করানো ও বাঘার নাম জড়ানোয় শিল্পাঞ্চলে খুনখারাপির পুরোনো দৃশ্যপট ফিরছে কিনা সেই আতঙ্ক ক্রমেই বাড়ছে বাসিন্দাদের মনে।
পুলিশের একাংশের কথায়, কানাইপুরে দাপট থাকাকালীন সস্তায় অনেক জমি কিনে রেখেছিল বাঘা। এখনও বাঘার স্ত্রীর নামে কয়েকশো বিঘা জমি রয়েছে কানাইপুরে। সেই জমি কেনার জন্য ভাঙড়ের একটি কোম্পানির সঙ্গে কথা হয় বাঘার। কিন্তু জমি বিক্রির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কানাইপুর পঞ্চায়েতের সদস্য পিন্টু চক্রবর্তী তথা মুন্না। সেই কারণেই পিন্টুকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করানোর অভিযোগ উঠেছে বাঘার বিরুদ্ধে।
অপরাধ জগতে অনেকদিন ধরেই নিষ্ক্রিয় ছিল বাঘা। নিমতা ও বাঁকুড়ার সোনামুখী থেকে টুকটাক জমির দালালি করে দিন গুজরান করছিল সে। ভাই বিশার ছিল মুরগির ব্যবসা। পুলিশের দাবি, এতদিন ধরে জমি বিক্রি করতে না পারার আক্রোশেই বাঘা তার অপরাধ জগতের পুরোনো নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে ভাই বিশার মাধ্যমে আনকোরা ও নতুন বিশ্বজিৎ ও দীপককে ভাড়া করে।
মাছের আড়তে কাজ করা বিশ্বজিৎ প্রামাণিক দিনে কয়েকশো টাকা আয় করত। দীপকও ভ্যান চালিয়ে কয়েকশো টাকার বেশি রোজগার করতে পারত না। এক ঝটকায় দু'জনে তিন লাখ টাকার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। যে কারণে সুপারির টাকাতেই বাঘা ও বিশার কথা মতো পিন্টুকে কাটারি দিয়ে নৃশংস ভাবে কুপিয়ে কব্জি কেটে খুন করে বিশ্বজিৎ। তাকে সঙ্গ দেয় দীপক। পিন্টু খুনের ঘটনায় পুলিশ বাঘা, বিশা, বিশ্বজিৎ ও দীপক-সহ চারজনকেই গ্রেপ্তার করেছে।