• বেড়ালের তালব্য শ ও অমিত মালব্য
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০৬ আগস্ট ২০২৫
  • সৈয়দ হাসমত জালাল

    সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’-এর সেই বেড়ালটির কথা মনে আছে তো? যে বলেছিল, ‘চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা– হল চশমা। কেমন, হল তো?’ এছাড়াও সে তিব্বত যাওয়ার সিধে রাস্তা বাতলেছিল এইভাবে– ‘কলকেতা, ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যস! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘন্টার পথ, গেলেই হল।’ আসলে অমিত মালব্য বেড়ালের তালব্য শ-এর মতোই একটি উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই।’ এই কথা শুনে  ‘হ য ব র ল’-এর বেড়ালটি নিশ্চয় এক চোখ বুজে ফ্যাচফ্যাচ করে হেসে উঠত!

    বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যের মতে, ‘বাঙালি একটি জাতির নাম, কোনও ভাষা নয়।’ তিনি বোধহয় ভুলে গেছেন, বাঙালি জাতি বোঝাতে ইংরেজিতে লেখা হয় ‘Bengalee’ আর বাংলা ভাষা বোঝাতে লেখা হয় ‘Bengali’। এই দুটির অর্থ তিনি গুলিয়ে ফেলেছেন। বাংলা ভাষা ভারতের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা এবং কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃত ‘ধ্রুপদী ভাষা’ও। দিল্লি পুলিশের ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলাকেও তিনি সমর্থন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি জানেন না, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষাও বাংলা। সেখানকার সংবিধানে সে কথাই লেখা আছে। এছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ নিখাদ বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা। মজার কথা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে অমিত মালব্য বলেছেন, এটা নাকি ‘সংস্কৃতায়িত বাংলা’। তিনি জানেন না, ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ সঙ্গীতটিও নিখাদ বাংলা ভাষায় লেখা।

    বড় অদ্ভুত কথা, বেশ কিছু বাঙালি প্রায় অন্ধের মতো অমিত মালব্যের ওই জ্ঞানগর্ভ কথাকে সমর্থন করছেন। কেউ কেউ এ কথাও সমাজমাধ্যমে লিখেছেন যে, বাংলাদেশের নাগরিকরা ‘বাঙালি’ নন, তাঁরা বাংলাদেশি। আসলে এইসব ব্যক্তি জানেন না যে, বাংলাদেশের একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব ‘বাংলাদেশি’, কিন্তু জাতিতে তিনি ‘বাঙালি’। যেমন, ভারতীয় বাঙালিদের নাগরিকত্ব ‘ভারতীয়’, কিন্তু জাতিতে ‘বাঙালি’। বাংলাদেশের বাঙালিরাও নিজেদের বাঙালিই মনে করেন বা বলে থাকেন। বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কে সামান্য ধ্যান-ধারণা যাঁদের আছে, তাঁরা বিষয়টি বুঝবেন। ভারতের ও বাংলাদেশের প্রমিত বাংলা একই। তবে আঞ্চলিকতার প্রভাব তো থাকবেই। বাংলাদেশের অধিকাংশ কবির কবিতাতেই ‘পানি’র বদলে ‘জল’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। গত এক বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে বর্তমানে সেখানকার ধর্মান্ধ শাসকদের ভাবনার প্রতিফলন সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে। ভাষার ক্ষেত্রেও এই মৌলবাদের পরিচয় এখন স্পষ্ট।

    মনে রাখা দরকার, পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন এলাকায় বাংলা ভাষার ব্যবহার ভিন্ন ভিন্ন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাংলা ভাষার সঙ্গে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বাংলার অনেকটাই তফাৎ চোখে পড়ে। আবার এইসব এলাকার থেকে মুর্শিদাবাদ, মালদহের কথ্য ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। প্রায় ৪০ কিলোমিটার ব্যবধানে মানুষের কথ্য ভাষা ও উচ্চারণ বদলে যায়। একইভাবে সিলেটের বাংলা ভাষার সঙ্গে বরিশালের বা চট্টগ্রামের কথ্য ভাষার পার্থক্য ঘটে যায়।

    বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যও সমর্থন করেছেন দিল্লি পুলিশ ব্যবহৃত ‘বাংলাদেশি ভাষা’ ও অমিত মালব্যের ব্যাখ্যাকে। তিনি বলেছেন যে, কোনটা সুবোধ সরকারের আর কোনটা শফিকুল ইসলামের লেখা, তা পড়লেই বোঝা যায়। সাহিত্যের ভাষায় যে স্থানিকতার প্রভাব থাকে, তাকে অস্বীকার করলেই এরকম উক্তি করা সম্ভব। বাংলাদেশে সাহিত্যে পানি, নামাজ, আব্বা, চাচা, ফুফু ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার থাকলেই তা ‘বাংলাদেশি ভাষা’ হয়ে গেল? পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের মুসলমান বাঙালিরাও ওই শব্দগুলি ব্যবহার করে থাকেন। তবে বাইরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে চলাফেরা ও কথোপকথনের ক্ষেত্রে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হিন্দু ব্যবহৃত শব্দই ব্যবহার করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের বহু শিক্ষিত পাঠকের অভিযোগ, বাংলাদেশের বাঙালিরা কেন ওই ভিন্নধর্মী শব্দ ব্যবহার করেন? ওইসব শব্দের অধিকাংশই তদ্ভব ও আরবি-ফার্সি থেকে উদ্ভূত এবং বাংলা ভাষায় এরকম আরবি-ফার্সি থেকে আসা বহু শব্দ মিশে গেছে, যা বাঙালি হিন্দুরাও কথোপকথনে বা লেখায় ব্যবহার করে থাকেন। ভাষার কোনও ধর্ম নেই, সে কথা তাঁরা ভুলে যান। প্রয়াত দুই সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সমরেশ মজুমদার তাঁদের একাধিক সাক্ষাৎকারে ও রচনায় বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের সাহিত্যে পানি, নামাজ, আব্বা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার এপারের বাঙালি হিন্দু পাঠক মেনে নিতে পারেন না– এ আসলে এখানকার পাঠকদেরই মানসিক সংকীর্ণতা। হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করা মুসলমান প্রতিবেশীদের ভাষা ও ব্যক্তিগত সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীন বাঙালি হিন্দু সমাজ। আর এই মানসিক দূরত্বের কারণেই এরকম ধারণা তৈরি হয়েছে।

    শোনা যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় নাকি বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের প্রিয় কবি। পারিবারিক ও লেখালেখির সূত্রে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে খুব কাছের থেকে জানার সুযোগ হয়েছিল বলেই বিস্মিত না হয়ে পারি না, এরকম একজন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানুষ ও কবির কবিতার ভক্ত কেউ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে কীভাবে যুক্ত থাকতে পারেন? ইদানীং অবশ্য এরকম মানুষের সংখ্যা কম নয়, যাঁরা মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলগীতি গান বা রবীন্দ্রনাথের ও নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেন, অথচ মনের মধ্যে পুষে রাখেন সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, এই সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা বড় ভয়ঙ্কর। আসলে আমাদের মধ্যে বহু বাঙালিই বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণদেব, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, নজরুলের মতো মহান বাঙালির আদর্শ অনুধাবন করতে পারেননি। বাঙালি জাতির পক্ষে এই ব্যর্থতা বড় দুঃখের। আর এ কারণেই ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর প্রবক্তারা ও তাঁদের সমর্থকরা এইভাবে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে আক্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)