এক সপ্তাহ আগের দুপুরে এখানে ভাত সেদ্ধ হওয়ার গন্ধ ছিল। সঙ্গে মশলাদার সব্জির ঘ্রাণ। ক্রোধ, হতাশা, আতঙ্কের পাঁচমেশালি ছবি এবং দশ ফুট বাই দশ ফুটের সংসার থেকে যতটুকু বেঁধে ছেঁদে নেওয়া যায় তার যুদ্ধকালীন তাড়া।
আজ সেখানে বর্ষাকালের মরে আসা আলোয়, দিনদুপুরে শ্মশানের স্তব্ধতা। গাড়ি থেকে নেমে সেক্টর ৪৯-এর বেঙ্গলি মার্কেট-এর (মূলত বস্তি) পেটের ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করতে ভয় লাগে। ঘেয়ো কুকুর বাহিনী ছাড়া কিছু নেই। নিয়মিত খাবারের অভাবে তেড়ে আসছে যেন। একপাশে ডাঁই ব্যবহারের যোগ্যতাহীন ভাঙা আসবাব, প্লাস্টিকের পাহাড়।
“তিন দিন হয়ে গেল একদম একা। এ বার পালাব।” প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করছেন পূর্ণিয়া থেকে আসা আফরোজ আলম। হিন্দিভাষী বলে তাঁর উপর চাপ আসেনি ঠিকই। “কিন্তু রাতারাতি প্রায় এক হাজার মানুষের বস্তি শুনশান হয়ে গেলে সেখানে কি থাকা যায়?”
একরাশ ভয় আর অনেকটা মনখারাপ নিয়ে বস্তির এক কোণে একটা খাটিয়ায় বসে আফরোজ। সম্বল বলতে হাতের মোবাইলটি। খোঁজখবর নিতে এসেছে এক জন, এতেই যেন যথেষ্ট ভার লাঘব হচ্ছে তাঁর। সাড়ে ন’বছর ধরে এই বস্তির হিন্দু-মুসলমান বাঙালিদের সঙ্গে সুখদুঃখ ভাগ করে নিয়েছেন আফরোজ। লোহা ঝালাইয়ের কাজে সিকান্দরপুরে যান প্রত্যহ। এ বার পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে পূর্ণিয়ায় ফিরবেন বা অন্য মহল্লায় চলে যাবেন, যেখানে মানুষ আছে। কারণ এই শূন্যতার মধ্যে থাকা যায় না, আর নিরাপত্তার প্রশ্নটাও চলে আসে।
গত সপ্তাহে ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই মালদহের গোলাম রসুল বলেছিলেন, “১৪ বছর রয়েছি এই বস্তিতে। কোনও সমস্যা হয়নি। এখন বস্তির মালিকই বলছে, আমরা যেন মানে মানে উঠে যাই। কাগজপত্র সব ঠিক করে পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে যেন আসি। কাগজপত্র ঠিক আর কী করব? আমাদের বাপ-দাদার তো মালদহে কোনও জমি নেই যে, তার কাগজ দেখাব।”
এক হাতে আধার অন্য হাতে ভোটার কার্ড নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন রসুল। তাঁর পাশে দাঁড়ানো গঙ্গারামপুর থানা থেকে আসা সেলিম খান বলেছিলেন “উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকেও লোক আসছে। ওদের তো ভাগাচ্ছে না।’’ সবাই ট্রাকে মাল তুলতে ব্যস্ত বলেই বোধহয় বাইরে উনুন করে গণহারে ভাত, সব্জি, মাছ রান্না হচ্ছিল সেই দুপুরে।
এখন শুকনো খটখটে মাছবিক্রেতা সিরাজুলের চৌবাচ্চা। এখানে মোবাইল রিচার্জ থেকে সেলুন, চায়ের দোকান সবই ছিল। স্বগতোক্তির মতো আফরোজ বলছেন, “রাত একটাতেও এই চাতাল জমজমাট থাকত। যেন মেলা বসেছে। বাচ্চাদের হইচই, গানবাজনা, মোবাইলে সিনেমা দেখা চলত মাঝরাত পর্যন্ত। আমার কাজ সেরে ফিরতে রাত হত। চা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান ভাইদের সঙ্গে বসে গল্প করে ঘরে ঢুকতাম। এখন তো আতঙ্কে যে কয়েক ঘর হিন্দু ছিল, তারাওচলে গিয়েছে।”
বাংলা ভাষায় কথা বলার ‘অপরাধে’ এক সপ্তাহের মধ্যে জীবন্ত কলোনি, শ্যুটিং শেষ হয়ে যাওয়া সিনেমার সেটের মতো পড়ে আছে।