• সম্মান বড় বালাই! বৈভব ছেড়ে শ্বাপদ সঙ্কুল ‘পর্ণকুটিরে’ বাস কাটোয়ার বৃদ্ধের
    বর্তমান | ০৫ আগস্ট ২০২৫
  • অনিমেষ মণ্ডল, কাটোয়া: প্রবাদ বলে, ‘আজ যে রাজা, কাল সে ফকির!’ হাতেগরম উদাহরণ অসিত মণ্ডল। ষাটোর্ধ বৃদ্ধ তিনি। তাঁর আত্মসম্মান বড়  বালাই। জীবনে সেই সম্মানকে অগ্রাধিকার দিয়ে সব হারিয়েছেন। এখন থাকেন কাটোয়ার চর কালিকাপুর গ্রামে বাঁধের নীচে ‘পর্ণকুটির’-এ! একদা বড়লোকের ছেলে ছিলেন অসিতবাবু। পরিবারের প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি। বাবার মৃত্যুরপর সবকিছু দ্রুত বদলাতে থাকে। ভাই-বোনদের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। ঘর ছেড়ে নতুন ঘর গড়েছিলেন। সেটাও মানসিক দ্বন্দ্বে যায়। তারপর থেকেই বৃদ্ধের ঠিকানা ওই কাটোয়ার চর কালিকাপুরে। ঘর বলতে বাঁধের নীচে মরিচা ধরা টিনের ছাউনি। কাঠামো বলে কিছু নেই। ঝোপ-ঝাড় জঙ্গলে ঢাকা চারিদিক। একটি ভাঙা দরজা। দু› পাশে লতাপাতায় ঘেরা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে ‘পর্ণকুটির’। ভাগীরথীর বাঁধ থেকে নেমে দরজা দিয়ে ঢুকলেই দুর্গম অসিতবাবুর শোয়ার ঘর। নোংরা আবর্জনায় ভর্তি।চক্কর কাটছে মশার দল। সাপেদের বাস। তাদের হিসহিস শব্দ অবশ্য কানে শুনতে পান না তিনি। সেখানেই প্রায় একযুগ বসবাস করছেন অসিতবাবু। সঙ্গী কেবল একটি গোরু। সেটিকে একই চালাঘরে রেখে একটি চৌকিতে ঘুমোনতিনি।

    এখন ভরা বর্ষা। ভাঙা টিনের ছাউনি দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ে৷ রাতে লক্ষ তারার আলো ঘরে ঢোকে। অথচ, একসময় মাথার উপর ছিল পাকা ছাদ। সকালের টিফিন থেকে রাতের খাবার—ভুরিভোজ। এখন ঠিকঠাক খেতে পান না। বড় অসহায় অসিতবাবু। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রাস্তায় ঘুরতে হয়৷ গরুর দুধ বিক্রি আর কলার থোড় বিক্রি করে একার সংসার সবদিন চলে না। মাঝেমধ্যে ভিক্ষে করতে হয়। খাবার বলতে দুটো আলু সিদ্ধ ও এক মুঠো ফ্যান ভাত। সারাদিনে একবার খান। 

    বৃদ্ধ অসিত বাবু হেসে বলেন, ‘সাপের সঙ্গেই আমার শান্তির বাস। সাপের শব্দ আমার কানে আসে না৷ কারণ, আমি কানে শুনতে পাই না। আত্মীয় স্বজনদের কাছে ফিরে যাব না। সবাই বেইমান। জীবনে বাকি যে ক’ দিন বাঁচব একাই থাকব।’অসিতবাবুর আসল বাড়ি নদীয়া জেলার শান্তিনগরে। তাঁরা দুই ভাই ও ছয় বোন ছিলেন৷ অসিতবাবু সবার বড়৷ তাঁদের জমিজমা বিষয় সম্পত্তি সবই ছিল৷ বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই ও বোনেদের বিয়ে দিয়ে নিজের আর বিয়ে করা হয় নি৷ তারপর ভাই ও বোনেদের সঙ্গে তাঁর মতের অমিল ঘটে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে৷ সেই অভিমানে তিনি তিরিশ বছর আগে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসেন চর কবিরাজপুরের পাশের গ্রাম নদীয়া জেলার সাধুগঞ্জতে। সেখানে তিনি টিনের চালের বাড়ি করেছিলেন৷ সাত বিঘা জমিও কিনেছিলেন৷ ওই গ্রামেই অসিতবাবুর এক বোন থাকেন৷ জমিগুলিভাগ চাষ করতে দিয়েছিলেন৷ সেখানেও অসিতবাবুর বোনের সঙ্গে তাঁর মনোমানিল্য হয়। তারপর তিনি নদীয়া ছেড়ে পূর্ব বর্ধমানের চর কালিকাপুরে বাঁধের নীচে ঘর বাঁধেন।শান্তিনগরে তাঁর ভোটার কার্ড ছিল। এখন আর নেই। অসিতবাবুর কথায়, ‘পূর্ব বর্ধমানে নাম তোলার জন্য বহুবার আবেদন জানিয়েও কোনও লাভ হয় নি।’ তাই সরকারি সুযোগ সুবিধাও পান না। গ্রামের বাসিন্দা সত্যেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, ‘এইভাবে যে একটা মানুষ থাকতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে কল্পনা করতে পারা যায় না৷ ওঁর খুব আত্মসম্মান বোধ।’
  • Link to this news (বর্তমান)