কল্যাণের ইস্তফা মুখ্য সচেতক পদ থেকে, বললেন, দিদি তাঁর প্রতি ‘অবিচার’ করলেন, দীর্ঘ পোস্ট সহকর্মী মহুয়ার বিরুদ্ধে
আনন্দবাজার | ০৪ আগস্ট ২০২৫
লোকসভায় তৃণমূলের সংসদীয় দলের মুখ্য সচেতকের পদ থেকে আচমকাই ইস্তফা দিলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার তৃণমূলের সাংসদদের নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বৈঠকের অব্যবহিত পরেই দলনেত্রীকে ইস্তফাপত্র পাঠান কল্যাণ।
লোকসভার মুখ্য সচেতকের পদ থেকে ইস্তফার কারণ হিসাবে শ্রীরামপুরের সাংসদ জানিয়েছেন, নেত্রী মমতা তাঁর উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তাই তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। কিন্তু সেটিই কি একমাত্র কারণ? না কি সহকারী সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সঙ্গে সংঘাতও রয়েছে এর পিছনে? ঘটনাচক্রে, ইস্তফা দেওয়ার কাছাকাছি সময়েই মহুয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে এক্স হ্যান্ডলে দীর্ঘ একটি পোস্ট করেছেন কল্যাণ। ঘটনাচক্রে, কল্যাণের ইস্তফার দিনেই মমতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে লোকসভার দলনেতা ঘোষণা করেছেন। সেটিও কি তাঁর ইস্তফার কারণ? কল্যাণ নিজে বলেছেন, অভিষেকের লোকসভার নেতা হওয়ার সঙ্গে তাঁর ইস্তফার কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর কথায়, ‘‘অভিষেকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভাল।’’
প্রসঙ্গত, কল্যাণ ইস্তফা দেওয়ার পর তাঁকে ফোন করেছিলেন অভিষেক। সূত্রের খবর, অভিষেক কল্যাণকে বলেছেন, আগামী তিন-চার দিন আগের মতোই মুখ্য সচেতকের কাজ সামলাতে। এত মান-অভিমান না-করতে। ৭ অগস্ট দিল্লি যাওয়ার কথা অভিষেকের। দিল্লি পৌঁছে তিনি কল্যাণের সঙ্গে বসে আলাদা করে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন বলে খবর। তৃণমূল সূত্রের খবর, কল্যাণ ইস্তফা দিলেও তা আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়নি। আবার অভিষেকের ফোনের পরে কল্যাণ ইস্তফার চিঠি প্রত্যাহার করছেন বলেও জানাননি। তবে অভিজ্ঞরা বলছেন, এর আগেও অনেক বার কল্যাণের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দলের ‘মন কষাকষি’ হয়েছে। কিন্তু কিছু দিন পরে আবার সব মিটমাটও হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, এ বারেও তেমনই হবে। আবার অন্য একাংশের বক্তব্য, লোকসভার সংসদীয় দলে কল্যাণের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করবে অভিষেকের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের উপর। তবে কল্যাণকে সমঝোতার পথে যেতে হলে ইস্তফাপত্র ফিরিয়ে নিতে হবে।
কল্যাণ জানিয়েছেন, লোকসভায় দলের সহকারী নেতা কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে তিনি বলেছেন, কল্যাণের জন্য যেন লোকসভায় পিছনের দিকের একটি আসন নির্দিষ্ট করা হয়। কল্যাণের সখেদ মন্তব্য, ‘‘আমার দরকার ফুরিয়ে গিয়েছে।’’ পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘এ বার দিদিই দল চালান!’’
ঘটনার সূত্রপাত সোমবার মমতার সঙ্গে দলের সাংসদদের ভার্চুয়াল বৈঠকে। তৃণমূল সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে রাজ্যসভার সংসদীয় দলের কাজ নিয়ে মমতা সন্তোষ প্রকাশ করলেও লোকসভার সাংসদদের মধ্যে ‘সমন্বয়’ নিয়ে তিনি অনুযোগ করেন। দলনেত্রী বলেন, লোকসভার সাংসদদের মধ্যে ঠিকমতো সমন্বয় হচ্ছে না। যা শুনে কল্যাণ মনে করেন, এটা আসলে তাঁর দিকেই আঙুল তোলা। তাঁর কথায়, ‘‘লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ। তিনি সংসদে যান না। উপদলনেতা কাকলি ঘোষ দস্তিদার কখনও যান, কখনও যান না। আমি এক দিকে মামলা করি, তার সঙ্গে সংসদ করি। আমার পক্ষে আর কতটা সম্ভব?’’ তৃণমূল সূত্রে এ-ও খবর যে, সংসদে কোন বিষয়ে কে বলবেন, সে ব্যাপারে মমতা কিছু জানতেন না বলে জানিয়েছিলেন ওই বৈঠকে। যাকে সরাসরি ‘অসত্য’ বলে দাবি করেছেন কল্যাণ। তাঁর কথায়, ‘‘দিদি এটা ঠিক বলেননি। এটা সত্য নয়। আমি সব জানিয়েছি দিদিকে।’’ ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সংসদে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে কল্যাণ বলেন, ‘‘আমি দিদিকে জানিয়েছিলাম। দিদি মহুয়া মৈত্রের নাম বলেছিলেন। আমি তখন বলি, মহুয়া বললে আমি সংসদে থাকব না। তার পরে দিদিই সায়নী ঘোষের নাম বলেন।’’ উল্লেখ্য, সিঁদুর অভিযান নিয়ে লোকসভায় তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলেছিলেন কল্যাণ নিজে এবং যাদবপুরের সাংসদ সায়নী। কল্যাণের বক্তব্য, মমতা তাঁর প্রতি ‘অবিচার’ করলেন।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, মমতার বৈঠক শেষ হওয়ার ঠিক পরেই ‘এক্স’ পোস্টে মহুয়ার বিরুদ্ধে তোপ দাগেন কল্যাণ। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে কল্যাণের প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তাঁর নাম না করলেও শূকরশাবকের সঙ্গে লড়াইয়ের পরিচিত উপমার উল্লেখ করেছিলেন মহুয়া। গত লোকসভা নির্বাচনে শ্রীরামপুরে কল্যাণের বিরুদ্ধে বামেদের প্রার্থী ছিলেন জেএনইউ-এর প্রাক্তনী দীপ্সিতা ধর। সেই সময়ে দীপ্সিতা সম্পর্কে কল্যাণের নানা মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সাক্ষাৎকারে কল্যাণের সেই আচরণ এবং মন্তব্য সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মহুয়া বলেছিলেন, ‘‘শূকরশাবকের সঙ্গে কখনও লড়াই করতে নেই। সে চাইবে লড়াই করতে। কিন্তু আপনি করলে নোংরাটা আপনার গায়েও লাগবে।’’ এর পরেই মহুয়া বলেছিলেন, ‘‘নারীবিদ্বেষী, হতাশাগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতা সব দলেই রয়েছেন। সংসদেও তার প্রতিফলন রয়েছে।’’
প্রসঙ্গত, কয়েক মাস আগে মহুয়ার সঙ্গে কল্যাণের খটাখটি বেধেছিল। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সামনে দু’জনের বাদানুবাদ চরম পর্যায়ে পৌঁছোয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, কল্যাণকে দেখিয়ে সেখানে কর্তব্যরত বিএসএফ, সিআইএসএফ জওয়ানদের উদ্দেশে মহুয়া বলেছিলেন, ‘‘ওঁকে অ্যারেস্ট করুন!’’ সেই ঘটনার পর কল্যাণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন দমদমের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়। যিনি আপাতত অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তখন পাল্টা সৌগতকে ‘নারদার চোর’ বলেছিলেন কল্যাণ। তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছিল, তা নিয়ে মহুয়া অভিযোগ জানিয়ে দলনেত্রী মমতাকে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। পুরো বিষয়টি তিনি জানিয়েছিলেন অভিষেককেও। কিন্তু দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের কোনও উন্নতি হয়নি। ঘটনাচক্রে, এত দিন দলের তরফেও কোনও উচ্চবাচ্য করা হয়নি। সোমবারেই প্রথম মমতা স্বয়ং লোকসভার সাংসদদের মধ্যে ‘সমন্বয়ের অভাব’ নিয়ে প্রকাশ্য বৈঠকে অনুযোগ প্রকাশ করলেন। যার প্রেক্ষিতে মুখ্য সচেতকের পদ থেকে কল্যাণের ইস্তফা।
সোমবার এক্স পোস্টে মহুয়া সম্পর্কে কল্যাণ লেখেন, ‘‘সম্প্রতি একটি পডকাস্টে মহুয়া মৈত্রের মন্তব্য শুনেছি। যেখানে তিনি সহ-সাংসদকে ‘শূকরশাবক’ বলেছেন। যা শুধু অবমাননাকর নয়, সাধারণ নাগরিক রীতির পরিপন্থী।’’
সোমবার বিকাল থেকে একটি ভিডিয়ো ফুটেজ (আনন্দবাজার ডট কম সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি) সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, দিল্লির একটি বাংলোর সামনে গাড়ি থেকে নামছেন মহুয়া। সেই সময়েই মূল ফটক দিয়ে হেঁটে ঢুকছেন কল্যাণ। মহুয়াকে দেখেই তাঁকে স্বগতোক্তি করতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘আজকে দিনটা গেল রে!’’ যা থেকে স্পষ্ট যে, দু’জনের মধ্যে আকচাআকচি তিলমাত্র কমেনি।
সম্প্রতি কসবার আইন কলেজে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের পরে কল্যাণ এবং তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রের মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। দুই নেতার মন্তব্যের নিন্দা করেছিল তৃণমূল। দলের ‘এক্স হ্যান্ডল’ থেকে নিন্দা করে পোস্টও করা হয়েছিল তৃণমূলের তরফে। দলের সেই পোস্ট উল্লেখ করে সমাজমাধ্যমে মহুয়া লিখেছিলেন, ‘‘ভারতে নারীবিদ্বেষ দলের গণ্ডিতে আটকে নেই। কিন্তু তৃণমূলকে অন্যদের থেকে আলাদা করে একটাই বিষয়, আমরা এই ধরনের বিরক্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদ করি, তা সে যিনিই করুন না কেন।’’ তার পরেই ক্রুদ্ধ কল্যাণ বলেছিলেন, ‘‘আমি সব নারীকে সম্মান করি। কেবল ঘৃণা করি একজনকে। তিনি মহুয়া মৈত্র।’’ মহুয়াকে আক্রমণ করতে গিয়ে সেই পর্বে তাঁর বিবাহের প্রসঙ্গও টেনে এনেছিলেন কল্যাণ। বলেছিলেন, ‘‘আমি নারীবিদ্বেষী? আপনি (মহুয়া) এক মহিলার ৪০ বছরের বিবাহিত জীবন নষ্ট করে, তাঁকে কষ্ট দিয়ে সেই পুরুষকে বিয়ে করেছেন। আর আমি নারীবিদ্বেষী?’’ কৃষ্ণনগরে মহুয়া কোনও মহিলা নেত্রীকে উঠতে দেন না বলেও অভিযোগ করেছিলেন কল্যাণ। তবে মহুয়া তা নিয়ে তখন কোনও পাল্টা মন্তব্যের রাস্তায় হাঁটেননি।
গত কয়েক মাস ধরে নানা ঘটনায় ইঙ্গিত মিলছিল, লোকসভায় তৃণমূলের সংসদীয় দলে সব ‘ঠিকঠাক’ চলছে না। এর মাঝে কীর্তি আজাদের সঙ্গেও একটি বিষয়ে সংঘাত তৈরি হয়েছিল কল্যাণের। সেই আবহেই সোমবারের বৈঠকে ‘সমন্বয়ের অভাব’ নিয়ে সরব হন মমতা। যে ঘটনায় ক্ষুব্ধ কল্যাণ সরাসরিই বলেছেন, ‘‘দিদি আমার প্রতি অবিচার করলেন!’’ পাশাপাশি তাঁর এ-ও বক্তব্য, ‘‘মহিলাকেন্দ্রিক দলে মহিলাদেরই প্রাধান্য। পুরুষদের কোনও গুরুত্ব নেই।’’