ভিন রাজ্যে আক্রান্ত বাঙালি, চোখে ঠুলি পরে আছেন কিছু বুদ্ধিজীবীও
দৈনিক স্টেটসম্যান | ৩১ জুলাই ২০২৫
ভিন রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি শ্রমিকদের হেনস্থার খবর প্রতিদিনই চোখে পড়ছে। তাঁদের শুধু হেনস্থাই নয়, যেভাবে তাঁদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে সেই সব রাজ্যের পুলিশ তা শুধু অন্যায়ই নয়, ভয়ঙ্কর অমানবিকও। ভারতের যে কোনও নাগরিক দেশের যে কোনও রাজ্যে বা প্রান্তে কর্মসূত্রে যেতে পারেন, থাকতে পারেন বা বসবাসও করতে পারেন। ভারতের সংবিধান এ দেশের নাগরিকদের সেই অধিকার দিয়েছে। সুতরাং অন্য রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে তাঁদের উপর যেভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, তা চূড়ান্ত বেআইনি এবং অসাংবিধানিক। ওই বাঙালি শ্রমিকেরা তাঁদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি পরিচয়পত্র দেখালে সেখানকার পুলিশ সেসব ধর্তব্যের মধ্যে তো আনেই না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই ওইসব পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এমনকি পুলিশ তাঁদের কাছে যথেষ্ট টাকাপয়সাও দাবি করে। আর তা দিতে না পারলে মিথ্যা কেস দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়। অনেক সময় কোনও কেস না দিয়ে তাঁদের জোর করে বাংলাদেশের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
এরকমই বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতার সাক্ষী মুর্শিদাবাদ জেলার হরিহরপাড়ার শামিম শেখ। শামিম দীর্ঘদিন ধরেই মুম্বইয়ের থানেতে শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সেখানে আরও অনেক বাঙালি শ্রমিক কাজ করেন। তাঁরা কাজের পর সন্ধেবেলা সেখানে একটি চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে গল্প করতেন। সম্প্রতি তাঁদের সবাইকে মীরা রোড থানার পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায়। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন। শামিমের কাছে সেদিন যা টাকা ছিল, থানায় তাঁর সেই টাকা কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় পুনেতে। সেখানে একটি বন্দি শিবিরে আটকে রাখা হয় তাঁর মতো প্রায় ২০০জন শ্রমিককে। কোনও কথা বলতে গেলেই তাঁদের জোটে পুলিশের মার। তাঁদের সবারই দু’হাত বেঁধে রাখা হয়। দু’দিন পর একটি বিমানে তাঁদের সবাইকে নিয়ে আসা হয় পশ্চিমবঙ্গের বাগডোগরা বিমানবন্দরে। বেশ কয়েকটি গাড়ি ভর্তি বিএসএফ তাঁদের নিয়ে যায় বাংলাদেশ সীমান্তে। তারপর কাঁটাতারের মধ্যে একটি ছোট গেট দিয়ে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশে। বার বার আপত্তি জানাতে গেলে বিএসএফ তাঁদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। বাংলাদেশ এলাকায় একটি বিশাল জঙ্গলের মধ্যে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় প্রশাসনের কাছে কোনওভাবে সে খবর পৌঁছয়। পরে প্রশাসনের সাহায্যে তাঁরা বাড়ি ফিরে আসতে পারেন। এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বলার সময় শামিম জানালেন, বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল কিন্তু তিনি কোনও কাজ করতে পারছেন না। দু’দিন কাজ করতে গেলেও শরীরের নানা জায়গায় তীব্র ব্যথার কারণে আর যেতে পারছেন না। তাঁর আতঙ্ক এখনও কাটেনি। শামিমের পূর্বপুরুষ হরিহরপাড়ার বাসিন্দা, তাঁর জন্মও হরিহরপাড়াতে। একজন ভারতীয় বৈধ নাগরিককে কেন অন্য রাজ্যে এভাবে নির্যাতিত হতে হবে? এর দাযিত্ব কি কেন্দ্রীয় সরকার নেবে না? ওই রাজ্যের পুলিশদের এরকম বেআইনি কাজের দায়িত্ব ওই রাজ্যের সরকারের উপরেও বর্তায়। আর বিএসএফ-এর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। এই বিষয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, পথে নেমেছেন। তার পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা কেন্দ্র সরকার এ বিষয়ে নিশ্চুপ কেন?
হরিয়ানার গুরুগ্রামে একইভাবে আটকে রাখা হয়েছিল মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর থানার রাঙাইপুর গ্রামের ৭জন শ্রমিককে। যদিও তাঁরা ঘরে ফিরেছেন, কিন্তু তাঁদের দুঃস্বপ্নের মতো অভিজ্ঞতা তাঁরা ভুলতে পারছেন না। মালদহ জেলা পরিষদের সদস্য মর্জিনা খাতুন ওই শ্রমিকদের এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আটকে রাখলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৰ্মশ্রী বা অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমে কাজের ব্যবস্থা করছেন। মুখ্যমন্ত্রী অন্য রাজ্যের শ্রমিকদের বাংলায় ফিরে আসার কথাও বলেছেন। রাজ্যের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিমন্ত্রী তাজমুল হোসেনও এই বিষয়টি দেখবেন।
ভারী অদ্ভূত ব্যাপার, প্রায় প্রতিদিনই এরকম খবর সামনে এলেও বাংলার কিছু বুদ্ধিজীবী ও বিজেপি নেতারা বিষয়টিকে কোনও গুরুত্ব দিতে নারাজ। বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য, বাংলা ভাষা বলার জন্য তো তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন না, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা আইটি সেক্টরের বাঙালিরা আক্রান্ত হননি। আক্রান্ত হয়েছেন কিছু শ্রমজীবী মানুষ। এক লেখিকা আবার যুক্তি দিচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে এই রাজ্যে মুসলিম তোষণ করছেন, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশে তা করা যায় না। ভোটের জন্য এই মেরুকরণ অসাংবিধানিক। তাঁর মতে, এই তোষণের কারণেই অন্য রাজ্যে মুসলিম শ্রমিকরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ভাবলে হাসি পায়, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিজেপির কোনও দোষ তাঁর চোখে পড়ে না। আর মুসলিমরা কি এই রাজ্যের নাগরিক নন? বোঝাই যায়, মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই নেই।
একটু ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যায়, হিটলারের জার্মানিতে আক্রান্ত হতেন ইহুদিরা। তখন অজুহাত দেওয়া হতো, ইহুদিরা নাকি কাজের ক্ষেত্রগুলো অধিকার করে নিচ্ছে। অনেকের মনে পড়তে পারে, আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য অসমেও এই একই যুক্তিতে ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলন করে কয়েক হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। আসলে এভাবেই বাঙালির বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে কেন্দ্রীয়ভাবেই। অদ্ভূত ব্যাপার, এই রাজ্যের বিজেপি নেতারা বাঙালি হয়েও, এইসব বাঙালির প্রতি সহানুভূতি থাকা তো দূরের কথা, বিষয়টি তাঁরা মানতেই রাজি নন। অবলীলায় এঁদের বাংলাদেশি বলে দেন তাঁরা। তাঁদের সুরে সুর মিলিয়ে ওই লেখিকাও সংবাদমাধ্যমে বলেন, এসব নাকি ‘উড়ো খবর’ বা ভুয়ো খবর!
নগর পুড়লে যেমন দেবালয় এড়ায় না, তেমনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি আক্রান্ত হলে তখন পার পাবেন না বুদ্ধিজীবীরাও। এ কথা বাঙালিরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই তাঁদের মঙ্গল।