দুই নদীকে বেঁধে রেখেছে শীর্ণকায় পার্বতী খাল। খাল পাড়ের বাসিন্দারা স্মৃতি পাতা ওল্টান, এর নাব্যতা-স্রোত আর নদীকে ঘিরে জীবন-জীবিকার ইতিহাস নিয়ে। দুই নদী— মরালি আর যমুনার সংযোগকারী ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এলাকার নিকাশি ব্যবস্থা সচল রাখায়।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নদিয়ার মরালি নদী থেকে বেরিয়ে বনগাঁ ব্লকের দিঘাড়ি, চৌবেড়িয়া ১ এবং চৌবেড়িয়া ২ পঞ্চায়েতের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পার্বতী খাল যমুনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। একটা সময় ছিল, এলাকার জল নিকাশি ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম ছিল এই খাল। নাব্যতা কমে মজতে থাকায় সঙ্কটে পড়েছেন স্থানীয়েরা।
খাল সংস্কারের দাবিতে তৈরি হয়েছে ‘পার্বতী খাল বাঁচাও কমিটি’। কমিটির পক্ষ থেকে খালটি সংস্কারের দাবিতে সেচ দফতর এবং প্রশাসনিক স্তরে আবেদন করা হলেওকোনও পদক্ষেপ করা হয়নি বলে অভিযোগ।
কমিটির আহ্বায়ক প্রদীপ সরকার বলেন, "২০০০ সালের বন্যার আগে পর্যন্ত খালটি ঠিক ছিল। নৌকো চলত। মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতেন। চাষিরা ধান, পাট, আনাজ হাটে-বাজারে নিয়ে যেতেন জলপথে। তবে বন্যার পরে খালে পলি জমে যায়। খালের পাড় দখল করে বেআইনি নির্মাণ ওঠে।’’
প্রদীপ জানান, খাল মজে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরা জীবিকা বদলেছেন। চাষিরা খেতে সেচের সমস্যায় পড়েছেন। আগে ভারী বৃষ্টির পরে জমা জল খাল হয়ে বেরিয়ে যেত। এখন খেত জলমগ্ন হয় বর্ষার মেঘভাঙা বৃষ্টিতেই। বাসিন্দারা জানালেন, খালটি সংস্কার না হওয়ায় কচুরিপানা, আগাছায় ভরে গিয়েছে।
খালপাড়ের বাসিন্দাদের বক্তব্য, আগে খালটি নদীর মতো চওড়া ছিল। স্রোত ছিল। কাছেই নহাটা বাজার। প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই বাজার। রোজ কয়েক হাজার মানুষ এখানে কাজে আসেন। কিন্তু নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলে যত্রতত্র জল দাঁড়িয়ে যায়। সেই জল পার্বতী খাল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মজা খালে গজিয়ে উঠেছে বসতি। খালের জমি কী ভাবে ব্যক্তি মালিকানায় এল তার উত্তর নেই কারও কাছে।
কয়েক বছর আগে একবার খালটি সংস্কারের জন্য সমীক্ষা করতে এসেছিলেন জেলা পরিষদের ইঞ্জিনিয়ারেরা। তারপরে কোনও এক অজানা কারণে আর কাজ এগোয়নি। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, পার্বতী খাল সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, "পার্বতী খালটি ওই এলাকার মানুষের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেচ দফতর এবং প্রশাসনের কাছে আবেদন করব খালটি সংস্কারের জন্য।’’
যে কোনও ভোটের আগে নিয়ম করে রাজনৈতিক প্রচারে খাল সংস্কারের বিষয়টি উঠে আসে। কিন্তু এক বার ভোটপর্ব মিটে গেলে খাল সংস্কারের কথা সকলেই ভুলে যান বলে অভিযোগ। নাব্যতা হারানো, স্রোতহীন পার্বতী খালের পাড়ে প্রবীণ মৎস্যজীবী নারায়ণ সরকার দাঁড়িয়েছিলেন। খেদের সঙ্গে বললেন, ‘‘একটা সময় ছিল, খালে মাছ ধরে সংসার প্রতিপালন করেছি। এই খালে প্রচুর বোয়াল মাছ পাওয়া যেত। সে সব এখন গল্লকথা। খালটার দিকে তাকালে এখন কষ্ট হয়।’’
তবুও তাঁর মতো এলাকার অনেকেই আজও স্বপ্ন দেখেন, খালের হাল ফিরবে। স্রোত আসবে। নৌকো চলবে।