মনসুর হাবিবুল্লাহ, দিনহাটা: দিনহাটা-২ ব্লকের বাদলগির রায়পাড়ায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এক হিজলগাছ। প্রায় তিন শতক ধরে গ্রামবাসীদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই গাছ এখন শুধু প্রকৃতির নিদর্শন নয়, একান্ত আপন ইতিহাসও বটে।
এক সময়ে দেবতার মর্যাদা পেত এই গাছ। মাটি, জল আর মানুষের বিশ্বাসে ছিল তার ঠাঁই। আজ আর পুজো হয় না, তবে গাছটিতে যেন আঁচড়টুকু না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখে গোটা গ্রামের মানুষ। কারও সাহস নেই তার ডাল ছাঁটার, কেউ ছেঁড়ে না পাতাও।
রায়পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা রাইচরণ রায়। তাঁর জমিতেই দাঁড়িয়ে আছে এই হিজলগাছ। স্মৃতির পাতা উল্টে রাইচরণ বলেন, যখন ছোট ছিলাম, দেখেছি এই গাছ ঠিক এমনই। শুনেছি, আমার ঠাকুরদা নাকি বলতেন এই গাছ কোনও দিন নড়ে না। ২০১১ সালে এক সরকারি আধিকারিক এসে মেপে বলেছিলেন,গাছের বয়স তখন ২৬৫ বছর। তিনি বলেছিলেন, গাছের গোড়াটা পাকা করে দেবেন। কিন্তু আর আসেননি।
গাছটিকে ঘিরে রাইচরণের একরাশ গর্ব, আর গলায় হালকা অভিমান। যেন এই গাছ তাঁর পরিবারেরই প্রবীণ কোনও সদস্য।
গ্রামের আর এক প্রবীণ ত্রৈলোক্যনাথ রায় বলেন, সনাতন ধর্মে গাছকে দেবতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। আগে তো এই গাছ পুজো পেত। এখন আর হয় না। তবে, আমরা কেউই এর ডাল ছেঁটে ফেলি না।
গ্রামের যুবক শিপিন রায় বললেন, বছরের একটা সময় সব পাতা ঝরে গেলে আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়। কয়েক মাস পর যখন কচি পাতা গজিয়ে সবুজ হয়ে ওঠে, আমরাও যেন নতুন করে বেঁচে উঠি।
দিনহাটার বাদলগির রায়পাড়া ছোট গ্রাম। বড় রাস্তা নেই, মোবাইল টাওয়ারের সিগন্যাল দুর্বল, রাতের শহরের আলোর ঝলকানি নেই। কিন্তু যা আছে, হয়তো আর কোথাও নেই। একটা গাছকে ঘিরে গোটা গ্রামের যত্ন, স্মৃতি আর ভালোবাসা। হিজলগাছ জল-কাদা-মাঠের সন্তান। নদীর ধারে জন্মায়। তার শরীরে অনমনীয়তা, শিকড়ে প্রবল শক্তি। জলমগ্ন হয়ে থাকলেও মারা যায় না। প্রকৃতির দাপটেও টলে না।
গ্রামবাসীরা বলেন, লোককথা রয়েছে যেখানে এই গাছ থাকে, সেখানে মঙ্গল হয়। হয়তো এ কেবলই গল্প, কিন্তু এমন গল্পেই তো গাঁয়ের জীবন বেঁধে থাকে। রায়পাড়ার এই প্রাচীন হিজলগাছ যেন মনে করিয়ে দেয় সবকিছুর বদলের মাঝেও কিছু ভালোবাসা কখনও বদলায় না। প্রকৃতিকে ভালোবাসলে হয়ে ওঠে মানুষের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। এই সেই হিজল গাছ। - নিজস্ব চিত্র।