• মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কেউ শহিদদের এভাবে মনে রাখেননি
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২২ জুলাই ২০২৫
  • একুশে জুলাই ১৯৯৩, সেদিনের আন্দোলনের সঙ্গে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। যার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তখন আমার বয়স খুব বেশি ছিল না। ময়দানের দিক থেকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মমতাদি ভাষণ দিতে তখন টি-বোর্ডের দিকে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি যখন ফিরছেন, ঠিক তখনই হঠাৎ গুলির আওয়াজ শুনতে পাই।

    সত্যি বলতে কী, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, এরকম একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কীভাবে গুলি চলতে পারে? শহর জুড়ে তখন বিশাল আকারে আন্দোলন চলছিল। ডালহৌসি চত্বরের পাঁচটা দিক থেকেই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। সব জায়গাতেই মমতাদি ঘুরে ঘুরে বক্তব্য রাখছিলেন। এমন সময় আশেপাশে গুলির শব্দ শুনে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা গুঞ্জন উঠল, ‘গুলি চলছে’। আমরা প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম, হ্যাঁ, সত্যিই গুলির আওয়াজ।

    তারপরই চারদিক থেকে শুরু হল হুড়োহুড়ি, দৌড়াদৌড়ি, মারামারি। ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারি আমাদের ১৩ জন ছেলে প্রাণ হারিয়েছে। আজও সেই কথা মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। সেই স্মৃতি ভুলতে পারিনি আজও।

    অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, অনেকে জখম হয়েছিলেন, কেউ কেউ পদপিষ্ট হয়েছিলেন। প্রাণের ভয়ে সেদিন প্রত্যেকেই দিশাহারা ছিলেন। আসলে, তৎকালীন সরকার আর পুলিশের ধারণা হয়েছিল, বোধহয় সত্যিই মহাকরণ দখল হয়ে যাবে। সেই আতঙ্কেই পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আমি। কিন্তু এমন নির্মমভাবে পুলিশকে গুলি চালিয়ে মানুষ মারতে সেদিন প্রথম দেখেছিলাম।

    একুশে জুলাই মানে আমাদের কাছে শুধুমাত্র একটা দিন নয়, সেই ভয়, সেই ক্ষোভ, সেই কান্না প্রতিবছরই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। নিহতদের পরিবারগুলো তখনই যেন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। একটার পর একটা লাশ সরিয়ে ফেলা, হাসপাতালে হুড়োহুড়ি করে আহতদের পৌঁছে দেওয়া, সবকিছু মিলিয়ে এমন বিভীষিকা আমি আর কখনও দেখিনি। এর মাঝেই পুলিশ অনেকের মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছিল। কী যে হয়েছিল সেদিন, এখনও স্পষ্ট মনে আছে।

    আমার রাজনৈতিক জীবনে বহু নেতা-নেত্রীকে দেখেছি, বহু রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আসতে ও যেতে দেখেছি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কেউ শহিদদের এভাবে মনে রাখেননি। তিনি শুধু মনে রাখেননি, তাঁদের পরিবারের পাশে থেকেছেন—মানসিকভাবেও, আর্থিকভাবেও। স্কুল-কলেজে তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্বও আমরা নিয়েছিলাম। তাই একুশে জুলাই আমাদের কাছে কোনও উৎসব নয়, এটা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিন। এই দিনটা আসলেই মানুষ আবেগে ভেসে আসে ধর্মতলায়। নতুন প্রজন্মও সেই আবেগ ধরে রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে।

    মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম, অনেক আন্দোলনেরই নেতৃত্ব দিয়েছেন। সিপিএমের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে তিনি বারবার সরব হয়েছেন। বাম আমলে আমাদের দক্ষিণপন্থী দলের প্রায় ৫৬ হাজার কর্মী নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের পরিবারের পাশে এখনও দাঁড়িয়ে আছেন মমতাদি। একুশে জুলাইয়ের যখন স্মৃতিচারণা হয়, তিনি সকলকে স্মরণ করেন। আমরা জানি, অনেক সময় দল ক্ষমতায় এলে অতীতকে ভুলে যায়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও সেই পরিবারগুলোকে মনে রাখেন। এখনও তাঁদের ডেকে মঞ্চে বসান, শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন, শ্রদ্ধা জানান। আমরা যারা রাজনীতি করি, তারা কর্মীদের নিয়েই কাজ করি। কর্মীদের সম্মান না দিলে সামনে এগোনো যায় না। সেটা আমরা শিখেছি আমাদের নেত্রীর কাছ থেকেই। অনুলিখন: শোভন মণ্ডল
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)