মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঁধভাঙা আবেগ। বৃষ্টি। নিজের রাজনীতিতে স্থির থাকার ঘোষণা।
ভাষা আন্দোলনের জন্য যদি ওপার বাংলায় এক ২১ শে অমর হয়ে থাকে, তাহলে এপার বাংলায় রাজনীতিতে মাইলফলক তৈরি করার জন্য ২১ জুলাইকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এবং ইতিহাসের অদ্ভুত সমাপতনে ওপার বাংলায়, আজকের বাংলাদেশে যখন জয় বাংলা স্লোগানকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন এই বাংলায় তৃণমূল সুপ্রিমো সেই জয় বাংলা স্লোগানকে বাঙালি অস্মিতার নির্মাণের বজ্রনির্ঘোষে পরিণত করেছেন।
২১ তাই অমর। এই বাংলাতেও। ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত গাওয়ার জন্য। যে কোনও অচলায়তনকে ভাঙার জন্য। রাজনৈতিক প্রতিরোধের নতুন শপথ নেওয়ার জন্য। আগে, অন্তত দুই দশক, ২১ জুলাই কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যবহার করেছেন সিপিএমের স্তালিনীয় সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণকে উপড়ে ফেলতে। আর গত এক দশক, ২১ জুলাই, তৃণমূলের কাছে বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিরুদ্ধে শপথ নেওয়ার দিন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিরি। সাংবাদিক হিসেবে ৩২ বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ দেখার পর আমার কাছে চুম্বক বা বুলেট পয়েন্ট কি বা কি কি? তৃণমূল নেত্রীর ক্যারিশমা। জনতার বাঁধভাঙা আবেগ। এবং অবশ্যই বৃষ্টি। ভরা বর্ষায় প্রতিবছর ২১ জুলাইয়ের শহিদ সমাবেশ হয় বলে, বৃষ্টি না হলে ঠিক ২১ জুলাই সম্পূর্ণতা পায় না! আর সবকিছুর পরে ওই ভিড় বা জনগণের আবেগকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বদলে দেওয়ার দক্ষতা। বছরের পর বছর ধরে দেখছি, উদ্বেলিত যে জনতা আসে, তাঁরা মমতা বন্দ্যোপধ্যায়ের বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে, বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করে আর ফিরে গিয়ে তৃণমূল নেত্রীর দেওয়া গাইডলাইনকে নিজেদের রাজনীতির রোডম্যাপ বানিয়ে নেয়। এটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সাফল্যের মূলমন্ত্র।
আমরা যারা প্রদেশ যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২১শে জুলাইয়ের সমাবেশ দেখেছি, তারপরে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করার পর তৃণমূল নেত্রী হিসেবে তাঁর অবিস্মরণীয় জনগণকে আকর্ষণ করার ২১শে জুলাই দেখেছি। এবং তারপরে ২০১১-র পরে ক্ষমতাশীল শাসক দলের প্রধান বা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২১শে জুলাইয়ের সমাবেশ পরিচালনা করতে দেখছি, তারা অবশ্যই একজন যুবনেত্রীর ‘ক্যারিশমাটিক প্রেজেন্স’ থেকে দেশের সবচেয়ে সফল রাজনীতিক এবং মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ‘ট্রান্সফরমেশন’ বা রূপান্তরটাকেও চিনতে পারি। গত ৩২ বছর ধরে ২১শে জুলাই কভার করার জন্য জানি কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ক্রাউড কন্ট্রোল বা ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, আবার কেন একমাত্র তিনিই বললে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও কেউ সমাবেশে ছাতা খুলে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করবে না, তা বুঝতে পারি। জনমোহিনী ক্ষমতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যে আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা আমাকে, সাংবাদিক হিসেবে আমাকে অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেছেন, সোনিয়া গান্ধীও বলেছেন। বিরোধী শিবিরের দুই শীর্ষ রাজনীতিক, সর্বভারতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক দুই নেতা-নেত্রী যখন একই মত পোষণ করেন, তখন ধরে নিতেই হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ক্যারিশমা’ আজ ‘ভারত-স্বীকৃত’।
৩২ বছরে ২১শে জুলাইয়ের শহিদ সমাবেশের অনেক কিছু বদলেছে। মঞ্চের হাইট বেড়েছে, পাশে সাংবাদিকদের জন্য আলাদা এনক্লোজার তৈরির বন্দোবস্ত হয়েছে, টালিগঞ্জের অভিনেতা অভিনেত্রীদের আসা সংখ্যায় এবং গ্ল্যামারের নিরিখে বেড়েছে। কিন্তু ২১শে জুলাই মানে আসলে শুধুই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগে আমার মতো অনেকেরই হয়তো অভ্যাস ছিল ভিক্টোরিয়া হাউজের সমাবেশ ছেড়ে দক্ষিণ দিকে আরও চলে যাওয়া, অর্থাৎ লেনিন সরণি পেরিয়ে এস. এন. ব্যানার্জী রোড অবধি ভিড় কতটা উপচে পড়ল তা দেখা। জীবনের প্রথম দিকে সাংবাদিকতা করার সময় যে সংবাদপত্রে চাকরি করতাম, সেখানে আর একটা অভ্যাস ছিল নিজের দেখা ভিড়ের সঙ্গে ‘টপ অ্যাঙ্গেল’ থেকে অশোক মজুমদারের তোলা ছবিকে মিলিয়ে দেখা।
কারণ, তখন বর্ষীয়ান আলোকচিত্রী অশোক মজুমদার আর আমি একই সংবাদপত্রে চাকরি করতাম। ৩২ বছরে আরও অনেক কিছুর মতো অশোক মজুমদারের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শহিদ সমাবেশে ছবি তোলার অভ্যাসটা বদলায়নি, অবশ্য তিনি এখন আর সংবাদপত্রের আলোকচিত্রী নন, মুখ্যমন্ত্রীরই ফটোগ্রাফার। কিন্তু এখনও আমি চেষ্টা করি এপাশে গণেশ অ্যাভিনিউ পর্যন্ত গিয়ে মুড়ি, আলু কাবলি বিক্রেতাদের কাছ থেকে জানতে তাদের বিক্রিবাটা কেমন বা সমাবেশের মুডটা ঠিক কীরকম!