• ‘ফের ভুল হলে মিশিয়ে দেব মাটিতে’
    আনন্দবাজার | ১৪ জুলাই ২০২৫
  • আবার সে এসেছে ফিরিয়া।

    পাগলা দাশুর গল্পে নয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। হুমকি প্রথার আমদানি এ বার কিছুটা নতুন মোড়কে।নতুন সংলাপে।

    কম নম্বর সত্ত্বেও পাশ করিয়ে দেওয়ার আবদার না মানায় বছরখানেক আগে এক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষককে এক চিকিৎসক-নেতার কাছে শুনতে হয়েছিল, ‘‘মেয়ে কোন রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরে? রোজ ফিরবে সেটা চান তো?’’ আর এ বার কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক এক সতীর্থের থেকে শুনলেন, ‘‘এক বার ভুল শোধরানোর সুযোগ দিয়েছি। ফের ভুল করলে মাটিতে মিশিয়ে দেব।’’ দক্ষিণবঙ্গের এক মেডিক্যাল কলেজের এক তরুণী চিকিৎসক হাসপাতালে ওষুধের অনিয়মিত সরবরাহ নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করায় তাঁর থেকে অনেক সিনিয়র এক শিক্ষক-চিকিৎসক বলেছেন, ‘‘অনেক তো দেখলে। কারা থাকল, কারা থাকবে, সেটা নিশ্চয় বুঝেছো। তা হলে ভুল পথে পা বাড়িও না। এর পর কিছু হলে কাউকে দোষ দিতে পারবে না।’’

    হুমকির মুখে পড়া ওই দুই শিক্ষকই আর জি কর আন্দোলনের মঞ্চে নিয়মিত থাকতেন। সেক্টর ফাইভ, ধৰ্মতলার অবস্থানে তাঁদের নিয়মিত দেখা গিয়েছে। আন্দোলন স্তিমিত হতে হতে যখন প্রায় মুছে যাওয়ার অবস্থা হল, বিচারের আশা প্রায় ছেড়ে দিলেন নির্যাতিতার বাবা-মাও, হুমকি প্রথা ফেরত এল নিজস্ব প্রতাপে। সে প্রতাপ এমনই যে, মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকতার সঙ্গে প্রায় ২০-২২ বছর যুক্ত কোনও কোনও চিকিৎসকও পাড়ার উঠতি গুন্ডাদের ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন সতীর্থদের সঙ্গে। খবর পৌঁছল স্বাস্থ্য ভবনেও। স্বাস্থ্য ভবনও পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখে বলতে শুরু করল, ‘একটু মানিয়ে চলুন। বোঝেনই তো সব।’

    কী বোঝাটা তা হলে এখনও জরুরি থেকে গিয়েছে স্বাস্থ্যে? ঠিক এক বছর আগে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুন ও ধর্ষণের ঘটনার পরে দেশজোড়া আন্দোলনের মুখে যখন মনে করা হচ্ছিল, স্বাস্থ্যে স্বচ্ছতা ফিরছে, কমছে হুমকি প্রথার দাপাদাপি, তখনও কি কেউ ভেবেছিলেন, বছর ঘোরার আগেই আবার সব জোর করে ‘একই ছাতার তলায়’ আনার চেষ্টা শুরু হয়ে যাবে? কেউ ভেবেছিলেন, যে আর জি কর থেকে ওই আন্দোলনের সূত্রপাত, সেখানকার অলিন্দেও অতি দ্রুত আবার শোনা যাবে শাসানির সুর? আর জি করের চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, ওই হাসপাতালের প্রতি আক্রোশমূলক মনোভাব দেখা দিচ্ছে হুমকি-চক্রের চাঁইদের। তাই বার বারই সেখানে সামান্য অজুহাতে কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা চলছে।

    সূত্রের খবর, এখন সামনের সারির মুখগুলো সামান্য অদলবদল হয়েছে। আগের বার বিভিন্ন কলেজে আন্দোলনের সময়ে যাঁদের নামে অভিযোগ এসেছিল, কলেজ কাউন্সিলের বৈঠক বসেছিল, তদন্ত হয়েছিল, যাঁরা সাসপেন্ড হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের সাসপেনশনে আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এঁদের অনেকেই এখন আবার তৎপর। কিন্তু এঁদের মাথায় স্নেহের হাত রেখে এ বার যাঁরা প্রকাশ্যে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, তাঁদের একেবারে সামনের সারিতে রয়েছেন উত্তরবঙ্গ লবির এক চিকিৎসক নেতা। রয়েছে এক বিধায়কের নামও। রয়েছে একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের নাম। শোনা যায়, অভীক দে-বিরূপাক্ষ বিশ্বাস জুটির রমরমা যখন তুঙ্গে, তখন ওই অধ্যক্ষই চিকিৎসকদের ওয়টস্যাপ গ্রুপে লিখেছিলেন, ‘অভীকআমার আদর্শ।’

    অভিযোগ, এ বার আর বিভাগ বেছে বেছে হুমকি নয়, রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজকেই কার্যত রাজনৈতিক দলের অফিসের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তৃণমূলের চিকিৎসক সংগঠন—‘প্রোগ্রেসিভ হেলথ অ্যাসোসিয়েশন’ (পিএইচএ) বিভিন্ন কলেজে ঘুরে ঘুরে বৈঠক করছে। আর জি কর আন্দোলনের অন্যতম মুখ, চিকিৎসক দেবাশিস হালদারের কথায়, ‘‘সামগ্রিকভাবে মেডিক্যাল শিক্ষাকেই নিজেদের কুক্ষিগত করার চেষ্টা চলছে।’’

    কলকাতার অন্যতম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ যেমন কলেজের অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতাদেরও নিমন্ত্রণের চিঠি পাঠিয়েছিলেন। হাসপাতালের অনুষ্ঠান মঞ্চ নেতাখচিত হয়ে খোলাখুলিই চেহারা নিয়েছিল শাসক দলের সভার। কারও আপত্তি, নিন্দার তোয়াক্কা করেননি তিনি। জেলার একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, পিএইচএ-র পদাধিকারী কলেজে ঘুরে ঘুরে বৈঠক করছেন। অভিযোগ, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি অন্য অধ্যক্ষদের বলছেন, ‘হয় আমাদের সঙ্গে থাকুন, না হলে হিসেব হবে’। অভিযোগ, তিনি পড়ুয়াদের বার্তা দিচ্ছেন, ‘আমাদের সঙ্গে থাকলে পাশ করা নিয়ে চিন্তা নেই। প্রশ্ন যতই কঠিন হোক।’

    কী বদলাল তা হলে? বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসক বললেন, ‘‘বদলানোর খুব আশা ছিল কি? বিষবৃক্ষের শিকড় তো থেকেই গিয়েছিল। আবার ডালপালা মেলা শুরু হয়েছে।’’

    আর জি কর, বর্ধমান, রামপুরহাট, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ, মালদহ মেডিক্যাল কলেজে হুমকি প্রথা বেশি রকম মাথা তুলেছে। এই মুহূর্তে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকেই হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠছে যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁদের অন্যতম রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ করবী বড়াল বলেন, ‘‘হুমকি তো একটা ধারণা। কে, কার, কোন কথাটা হুমকি বলে ধরে নিচ্ছে, সেটা তার ব্যাপার। পড়ুয়াদের অনেক অভিযোগ থাকে, সেগুলো আমি সংগঠনগত ভাবে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষদের শুধরে নিতে বলেছি। কোন কথাটা, কে ভয় পেয়েছেন, তার দায় আমার নাকি?’’

    স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ার দায় তা হলে কারা নেবেন? পিএইচএ-র প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী শশী পাঁজা বললেন, ‘‘নতুন করে হুমকির কথা তো কিছু শুনিনি। আমরা খবর রাখছি। তবে কেউ একটু কড়া হলে যদি বাকিরা সেটাকে হুমকি মনে করে, তা হলে আর কী করা যেতে পারে?"
  • Link to this news (আনন্দবাজার)