প্রশ্নপত্রে বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে উল্লেখ! দুই অধ্যাপককে পদ থেকে অব্যাহতি, সাফাই দিল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়
আনন্দবাজার | ১০ জুলাই ২০২৫
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রে বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তা নিয়ে বিতর্কের মুখে অবশেষে দুই অধ্যাপককে পদ থেকে অব্যাহতি দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বুধবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছিল, অনুবাদের ভুলে এই সমস্যা হয়েছে। কিন্তু তাতে বিতর্ক থামেনি। এর পর বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, অনিচ্ছাকৃত এবং অনবধানতাবশত এই ভুল হয়েছে। উপাচার্য দীপককুমার কর বলেন, ‘‘এর জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। দুঃখপ্রকাশ করছি। এ সবের সঙ্গে মানুষের ভাবাবেগ জড়িত। এই ঘটনা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। ভবিষ্যতে এর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, আমরা সেটা দেখব।’’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামকই পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। স্নাতক স্তরের জন্য ‘বোর্ড অফ স্টাডিজ’ নামের একটি কমিটি থাকে। তার এক জন চেয়ারম্যান থাকেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েরই সদস্য। বাকি যাঁরা থাকেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা বিভিন্ন কলেজের সদস্য। সেই বোর্ড অফ স্টাডিজের চেয়ারম্যান এবং আর এক সদস্যকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপাচার্য বলেন, ‘‘যে হেতু তাঁদের সই ছিল, তাই তাঁদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান যিনি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক জন অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা একটি কলেজের অধ্যাপক।’’
পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার স্নাতক স্তরের ষষ্ঠ সেমেস্টারের ইতিহাস পরীক্ষা ছিল। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল— ‘মেদিনীপুরের তিন জন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নাম কর, যারা সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নিহত হন?’ এই প্রশ্ন ঘিরেই বিতর্ক বাধে। অনেকেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ উল্লেখে ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান নির্মল মাহাতো আগেই জানিয়েছিলেন, ইংরেজির প্রশ্নপত্রে ‘মিলিট্যান্ট ন্যাশনালিস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ভুল হয়েছে অনুবাদের ক্ষেত্রে। বাংলা অনুবাদটা ঠিকঠাকই হত, যদি ওই শব্দটা ‘কোট-আনকোটের’ (বন্ধনীর) মধ্যে থাকত। বৃহস্পতিবার উপাচার্যও বলেন, ‘‘ইংরেজি শব্দের বঙ্গানুবাদে ভুল হয়েছে। তাতে শব্দ বাদ চলে গিয়েছে।’’
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ আমলে মেদিনীপুর বরাবরই বিপ্লবীদের শক্তঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। সেখানে পর পর তিন জেলাশাসককে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৩১ সালে জেলাশাসক পেডি খুন হয়েছিলেন। ’৩২ সালে খুন হন জেলাশাসক ডগলাস। আবার পরের বছর অর্থাৎ, ১৯৩৩ সালে খুন করা হয় জেলাশাসক বার্জকে। ঘটনা হল, পরাধীন ভারতে খবরের কাগজে বিপ্লবীদের ‘অ্যানার্কিস্ট’ বলে উল্লেখ করা হত। বাঘা যতীন ও যদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ‘অ্যানার্কিস্ট’ শব্দের ব্যবহার বন্ধ করার আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁদের ব্যাখ্যা ছিল, ‘‘বাংলার তরুণ দেশের জন্য প্রাণ দেবে আর ইংরেজরা তাঁদের ডাকাতের দল বলে প্রচার করবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।’’ তাঁরা খবরের কাগজে চিঠি দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিপ্লববাদী বা ‘রিভলিউশ্যানিস্ট’ লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও কেন বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী বলে উল্লেখ করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বহু মানুষ।
সে বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘‘ঔপনিবেশিক শব্দ যাতে পাঠ্যবইয়ে না থাকে, সেটাও দেখতে হবে। সিলেবাস তৈরির সময় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে ভুল হয়েছে, তা একেবারেই সাধারণ ভুল নয়। এই বিষয়টি আমরা অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’’