দিলীপের চেয়ার-বৃত্তান্ত: মুখ ফস্কেও মুখে আগল, বললেন না কবে-কোথায় ঘটেছিল, মন্থন শুরু বঙ্গ বিজেপির অন্দরমহলে
আনন্দবাজার | ১০ জুলাই ২০২৫
একটি বাক্য। তাতে সাতটি শব্দ। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষের মুখ থেকে শব্দগুলি বেরিয়েছিল বুধবার বিকেলে দিল্লিতে। কিন্তু সে শব্দগুচ্ছ ‘শব্দব্রহ্মে’র রূপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি দফতরে যে মন্থনের জন্ম দিয়ে দেবে, তা সম্ভবত বক্তাও বলার সময়ে বোঝেননি। পরিস্থিতি যখন ‘ইতিবাচক’ মোড় নিচ্ছে, বঙ্গ বিজেপিতে আবার যখন ‘শান্তিকল্যাণ’ আবহ, তখন বিতর্ক আর বাড়াতে চাইলেন না দিলীপ। বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার ডট কমকে বললেন, ‘‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না।’’ কিন্তু যে ঘটনার কথা দিলীপ বুধবার বলেছিলেন দিল্লির দফতরে বিজেপির সর্বভারতীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) শিব প্রকাশের সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরোনোর পর, তা নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতেও রাজ্য বিজেপিতে চর্চা থামেনি।
রাজ্য বিজেপির বৈঠক হচ্ছে, আর প্রাক্তন সভাপতি নাকি সামান্য একটা চেয়ারও পাচ্ছেন না! এমন ঘটনা কবে ঘটেছে, কখন কোন বৈঠকে বসার জন্য চেয়ার পাননি দিলীপ, ভাবতে শুরু করেছেন অনেকেই। দিল্লি থেকে দিলীপ জানিয়েছিলেন, দলের বৈঠকে নাকি তাঁকে চেয়ারই দেওয়া হত না। তাঁকে দল থেকে সরানোর জন্য অনেকে অনেক রকম চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু তিনি বিজেপির সঙ্গেই রয়ে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মান-অভিমান পার্টিতে চলতে পারে না। বাংলায় নির্বাচন আসছে। দল আমাকে যা দায়িত্ব দেবে, আমি তা পালন করব। পার্টির মিটিংয়ে আমাকে চেয়ারই দেওয়া হত না। যাঁরা আমাকে দল থেকে সরাতে চেয়েছিলেন, তাঁরা খুব চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমি কখনও বলিনি দল ছাড়ব। যে দলটাকে দাঁড় করিয়েছে, সে কেন দল ছাড়বে? কেউ ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে লড়বে।’’
মুখ ফস্কে করে ফেলা মন্তব্য নিয়ে দিলীপ বিতর্ক বাড়াতে না চাইলেও আলোচনা চলছে। দিলীপ রাজ্য বিজেপির সভাপতির দায়িত্ব ছাড়ার পর ওই পদে বসেছিলেন সুকান্ত মজুমদার। অতি সম্প্রতি নতুন সভাপতি হয়েছেন শমীক ভট্টাচার্য। এখন প্রশ্ন হল, কোন সময়ে দিলীপ বৈঠকে চেয়ার পাননি? তিনি নিজে রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন তো এমন ঘটনা সম্ভব নয়। তাঁর পরে যিনি সভাপতি হয়েছেন, সেই সুকান্তের সঙ্গে দিলীপের সম্পর্ক বরাবরই ভাল। এমনকি, উত্তরসূরী হিসাবে দিলীপই সুকান্তের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। সেই সুকান্তের আমলেই কি দিলীপ চেয়ার পাননি? তাঁকে দল থেকে সরানোর চেষ্টা হয়েছিল বলে আসলে কার দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি?
বস্তুত, রাজ্য বিজেপির অন্দরে সুকান্তের সঙ্গে দিলীপের সুসম্পর্ক থাকলেও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মধুর নয়। ২০২১ সালের ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দেন শুভেন্দু। দিলীপ তখন রাজ্য সভাপতি। তাঁদের কেন্দ্র করেই বিজেপির অন্দরে ‘নবীন-প্রবীণ’ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। শুভেন্দু-দিলীপ এই দ্বন্দ্ব প্রকট হয় কিছু দিন আগে দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের দিন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন দিলীপ। সে দিনই কাঁথিতে শুভেন্দুর সভা ছিল। দিলীপ সেখানে যাননি। পরে সুকান্ত জানিয়ে দেন, দিলীপের দিঘায় যাওয়া দল অনুমোদন করছে না। কারণ দলগত ভাবে ওই অনুষ্ঠানে না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দিলীপের যাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত। এমনকি, দিলীপ বিজেপি ছাড়তে চলেছেন বলে জল্পনাও তৈরি হয়েছিল সেই সময়ে। জল্পনা অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছিলেন দিলীপ নিজে। কিন্তু দিঘায় যাওয়ার পর থেকে বিজেপির অন্দরে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক আরও বেড়েছে। বুধবার বিকেলেও দিল্লিতে সেই সংক্রান্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হন দিলীপ। জানান, মমতার বিরুদ্ধে চুরি বা ডাকাতির কোনও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করায় কোনও সমস্যা হওয়া উচিত নয়। দিলীপ বলেন, ‘‘এক বারই তো ওঁর সঙ্গে দেখা করেছি। যাঁরা তা নিয়ে এত বড় বড় কথা বলছেন, তাঁদের নামে হয়তো মামলা রয়েছে। আর যাঁর নামে কোনও মামলা নেই, চোর-ডাকাত বলে যাঁকে কেউ প্রমাণ করেনি, তাঁর সঙ্গে যদি আমি বসি, আমি খারাপ হয়ে গেলাম? আমার ওখানে যাওয়ায় দলের কেউ কেউ অস্বস্তিতে ছিলেন। সমস্যাটা এটাই যে, আমাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন এত গুরুত্ব দিলেন।’’ কারও নাম নেননি দিলীপ। তাতেই জল্পনা বেড়ে গিয়েছে আরও।
রাজ্য বিজেপির নতুন সভাপতি শমীক বৃহস্পতিবার সকালেই দিল্লি চলে গিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে। আর সদ্যপ্রাক্তন সভাপতি সুকান্ত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিল্লি গিয়েছেন নিজের মন্ত্রকের কাজে। কলকাতা বা দিল্লি, কোথাওই তাঁরা কেউ দিলীপের এই মন্তব্য সম্পর্কে মুখ খোলেননি। শুভেন্দুকে অবশ্য কলকাতায় এই বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘’আমি কোনও মন্তব্য করব না। আমি এই বিষয়ে কথা বলি না।’’ প্রকাশ্য মন্তব্য এড়িয়েছেন এ রাজ্যে দলের সামনের সারিতে থাকা অন্য নেতারাও। কিন্তু দলের অন্দরে চর্চা বেড়েছে বই কমেনি। দিলীপকে কবে, কোন বৈঠকে চেয়ার দেওয়া হয়নি, তা মনে করতে দিনভর স্মৃতি হাতড়েছেন এঁদের অনেকেই। নাম না প্রকাশের শর্তে অধিকাংশেরই বক্তব্য, ‘’দিলীপ ঘোষকে দলের বৈঠকে চেয়ার দেওয়া হয়নি, এমন ঘটনার কথা মনে করতে পারছি না।’’ তবে দিলীপের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘’এত সুকৌশল কিছু ঘটনা ঘটানো হয়েছে, যা হয়তো সে ভাবে কারও নজরে পড়েনি। কিন্তু যাঁকে অপমান করার জন্য ঘটানো হয়েছিল, তিনি তো বুঝতে পেরেছিলেন। কারওকে কিছু বলেননি, হইচই করেননি। তাই কেউ জানতেও পারেননি।’’
দিলীপ বিশদে কিছু বলতে না চাওয়ায় স্পষ্ট হয়নি যে কোন কোন কর্মসূচিতে তাঁকে চেয়ার না-দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে, তিনি সে সময়ে যখন হইচই করেননি, তখন এত দিন পরে কেন এ প্রসঙ্গ তুললেন? দিলীপের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত বলছে, ‘‘বলার ইচ্ছা হয়তো ছিল না। কিন্তু অপমান তো ভুলতে পারেননি। তাই সম্ভবত মুখ ফস্কে ওইটুকু কথা বেরিয়ে গিয়েছে।’’
রাজ্য বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, দলের রাজ্য কার্যকারিণী বৈঠকে প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে দিলীপের আসন যেখানে থাকার কথা ছিল, সেখানে না থেকে পিছনের সারিতে থাকার ঘটনা একবার ঘটেছিল। এক কেন্দ্রীয় নেতার নজরে বিষয়টি আসায়, তিনি দিলীপকে সামনে ডেকে নেন বলে ওই সূত্রের দাবি। দিলীপের এক প্রাতভ্রমণ সঙ্গীর দাবি, ‘’দিলীপ দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি থাকাকালীনও এ রাজ্যে একবার এ রকম ঘটনা ঘটেছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উপস্থিতিতে হওয়া একটি কর্মসূচিতে সবার পদ অনুযায়ী চেয়ারের বিন্যাস ছিল। চেয়ারে নাম লেখা ছিল। দিলীপদার নাম লেখা চেয়ার যেখানে থাকার কথা ছিল, তার ধারেপাশেও দেখা যায়নি।’’