ভোটাধিকার থেকে কাউকে কি বঞ্চিত করা যায়? মহুয়াদের প্রশ্ন ভোটার তালিকা সংশোধনী নিয়ে, সুপ্রিম কোর্টে কী বলল কমিশন
আনন্দবাজার | ১০ জুলাই ২০২৫
বিহারের ভোটার তালিকায় সংশোধন নিয়ে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। বৃহস্পতিবার সেগুলি একত্র করে শুনানি শুরু হয় বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে। বৃহস্পতিবারের শুনানিতে মামলাকারীদের তরফে প্রশ্ন তোলা হয়, ভোটাধিকার থেকে কোনও এক জন ব্যক্তিকেও বঞ্চিত করা যায় কি না। কমিশনের কাজের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। কমিশন অবশ্য নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানায়, কাউকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে না তারা। আইন মেনেই যাবতীয় কাজ করা হচ্ছে। এই মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী বৃহস্পতিবার।
শুনানির শুরুতেই মামলাকারীদের আইনজীবী জানান, ১৯৫০ সালের আইন এবং ভোটার অন্তর্ভুক্ত আইনের অধীনে ভোটার তালিকায় দু’টি ধরনের সংশোধনের কথা বলা রয়েছে। এক, নিবিড় সমীক্ষা। দুই, সংক্ষিপ্ত সমীক্ষা। তিনি বলেন, “ইনটেনসিভ রিভিশন বা নিবিড় সংশোধন একটি ডি নোভো (নতুন করে) অনুশীলন। বিহারের ৭.৯ কোটি মানুষকে এই প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হয়েছে। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন আইন বা নিয়মে কোথাও উল্লেখ নেই। এটি ভারতের ইতিহাসে প্রথম বার করা হচ্ছে।”
মামলাকারীদের আইনজীবী জানান, ৩০ দিনের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ করার কথা বলা হয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, শুধুমাত্র ১১টি নথি গ্রহণ করা হবে। ভোটার আইডি নেবে না বলছে। বাবা-মায়ের নথিপত্র চাওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আদালতে তাঁর অভিযোগ, ২০০৩ সালের আগের ভোটার নথি নেওয়া হচ্ছে। ২০০৩ সালের পরে পাঁচটি লোকসভা ভোট হয়েছে। সেখানে যাঁরা ভোট দিয়েছেন এখন তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তার পরেই বিচারপতি ধুলিয়ার প্রশ্ন, এই প্রক্রিয়া কি কমিশন নিজের ইচ্ছায় করতে পারে? মামলাকারীদের আইনজীবীর উদ্দেশে বিচারপতির প্রশ্ন, “কমিশনের ক্ষমতাকে কি আপনারা চ্যালেঞ্জ করছেন?” মামলাকারীদের আইনজীবী বলেন, “না। আমরা কমিশনের কাজকে চ্যালেঞ্জ করছি।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “কমিশন নিজের ইচ্ছা মতো এটা করছে। নিয়মে কোথায় বলা নেই।” বিচারপতি বাগচী বলেন, “জনপ্রতিনিধি আইনের ১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তো মনে করলে কমিশন বিশেষ রিভিশন করতে পারে।”
মামলাকারীদের আইনজীবী জানান, প্রয়োজনে ভোটারদের আধার কার্ডের নম্বর দিতে বলা হচ্ছে। তাঁর উদ্দেশে বিচারপতি বাগচী বলেন, “আপনি বলতে চাইছেন যে আধার একটি বৈধ পরিচয়পত্র। এটি প্রমাণপত্র হিসেবে বাতিল করা হলে আইনের পরিপন্থী হবে?” আইনজীবী বলেন, “বলতে চাইছি ভোটার তালিকায় না-থাকা কোনও ব্যক্তির নাগরিকত্বের প্রমাণ আধার কার্ড হতে পারে। কিন্তু যাঁদের নাম ভোটার তালিকায় রয়েছে, তাঁদের জন্য আধার কার্ড পরিচয় যাচাইয়ের প্রমাণ হিসেবে কাজ করুক।”
আদালতে মামলাকারীদের আইনজীবী জানান, ভোটার তালিকা সংশোধনে আধার এবং ভোটার কার্ড বাদ দেওয়া হয়েছে। মহুয়ার আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, “একজন যোগ্য ভোটারকেও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা সমান সুযোগের নীতিকে ব্যাহত করে, গণতন্ত্রের উপর আঘাত হানে এবং সরাসরি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর উপর প্রভাব ফেলে।”
বিচারপতি বাগচী: জনপ্রতিনিধি আইনের ধারা ২১-এর উপ-ধারা (৩) ‘নির্ধারিত পদ্ধতি’ শব্দটি নেই। বরং ব্যবহৃত হয়েছে ‘যেমনটি উপযুক্ত ও যথাযথ মনে করে’। ফলে কমিশনকে প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তো?
সিঙ্ঘভি: কিন্তু এই প্রক্রিয়া কোনও ভাবেই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। এখানে ‘চূড়ান্ত ভোটার তালিকা’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও বিশেষ ও নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)-এর উল্লেখও নেই।
সিঙ্ঘভি: কেন জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বিজ্ঞপ্তি জারি করল কমিশন? বিহার ভোটার সংখ্যার দিক থেকে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য। এখন একই কাজ পশ্চিমবঙ্গে হতে চলেছে। রাজনীতি বাদ রেখে প্রশ্ন হল, একজন ব্যক্তিকেও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় কি না?
কমিশনের উদ্দেশে বিচারপতি ধুলিয়া: মামলাকারীরা ভোটাধিকার বা গণতন্ত্রের মূল শিকড় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা কমিশনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছেন না। তাঁরা বলছেন, কমিশনের কাজের পদ্ধতি নিয়ে। কমিশন কি এই পদ্ধতিতে ভোটার তালিকা সমীক্ষা করতে পারে?
আইনজীবী কপিল সিব্বল: কমিশনের এই পদ্ধতি ধরলে বলতে হবে এখন ভারতের নাগরিক হতে না-পারার একমাত্র কারণ হতে পারে — আমার বাবা-মায়ের মধ্যে কেউ একজন অবৈধ ভাবে এ দেশে এসেছেন। অথবা, আমার বাবা-মা উভয়ের জন্মতারিখ আমার কাছে নেই। কিন্তু সেই তথ্য কোথা থেকে পাওয়া যাবে? এটা কেউ বলছেন না? অনেক পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যের বাইরে রয়েছেন। এখন তাঁদের এসে ফর্ম পূরণ করতে হবে। আবার সেগুলোর যাচাই করার সময় থাকতে হবে। এই পদ্ধতি কি মেনে নেওয়া যায়?
কমিশনের আইনজীবী: ভোটার তালিকা প্রস্তুতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকি কমিশনের হাতে থাকে। সময়ের সঙ্গে কমিশন তা যাচাই করে।
বিচারপতি: বিশেষ সমীক্ষা নিয়মে নেই বলা হচ্ছে।
কমিশনের আইনজীবী: নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে ভোটারদের। কমিশনের এমন কোনও উদ্দেশ্য নেই এবং তারা কাউকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে না। আইন মেনেই কাজ করছে কমিশন।
বিহারের ভোটার তালিকার বিশেষ ও নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) নির্দেশ জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। চলতি বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে এই সংশোধনের কাজ সেরে ফেলতে চায় কমিশন। বিহারের ভোটারদের মধ্যে নির্দিষ্ট ফর্ম বিলি করা হয়েছে। তা পূরণ করে নথি-সহ জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট দফতরে। নথি হিসাবে দেখাতে হবে নিজের এবং বাবা-মায়ের জন্মের শংসাপত্র। আধার কার্ড বা রেশন কার্ডের মতো নথি এ ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে না। এতেই আপত্তি তুলেছে বিরোধীরা। অভিযোগ, এর ফলে তিন কোটি মানুষ ভোটাধিকার হারাতে পারেন। যাঁরা এত দিন ধরে ভোট দিয়ে আসছেন, কেন আবার তাঁদের নথি দিয়ে ভোটাধিকার প্রমাণ করতে হবে, প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন জানায়, ২০০৩-এর ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের সমস্যা নেই। কিন্তু বাকিদের মধ্যে যাঁদের জন্ম ১৯৮৭ সালের আগে, তাঁদের জন্মের প্রমাণপত্র দিতে হবে। তাঁদের ক্ষেত্রে গ্রাহ্য মোট ১১টি নথির কথা জানিয়েছে কমিশন। তাঁরা গত লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকলেও এই নথি দিতে হবে। এ ছাড়া, ১৯৮৭ থেকে ২০০৪-এর মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের নিজেদের এবং বাবা-মায়ের মধ্যে যে কোনও এক জনের জন্মের প্রমাণপত্র দিতে হবে। ২০০৪-এর পরে জন্ম হলে নিজের ও বাবা-মায়ের দু’জনেরই জন্মের প্রমাণপত্র দিতে হবে।
কমিশনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা রুজু হয়। মামলা করেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রও। মহুয়া ছাড়াও কমিশনের এসআইআরের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে অসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম্স, পিইউসিএল। মামলা করেছেন আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝা, সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদবও।
মহুয়া-সহ মামলাকারীদের অভিযোগ, এই নির্দেশ সংবিধান, জনপ্রতিনিধি আইনের বিরোধী। মহুয়া আবেদনে লেখেন, ‘‘ভারতীয় সংবিধানের ১৪, ১৯ (১), ২১, ৩২৫, ৩২৬ ধারা, জনপ্রতিনিধি আইন এবং ভোটার নিবন্ধনের নিয়ম লঙ্ঘন করছে কমিশনের নির্দেশ। তা যদি বাতিল না-করা হয়, এর ফলে বহু মানুষ ভোটাধিকার হারাবেন। এটা গণতন্ত্রের অসম্মান এবং দেশে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কাঁটা।’’ বাংলা-সহ অন্যান্য রাজ্যে যাতে এই পদক্ষেপ না করা হয়, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশও চান মহুয়া।