নিকাশিতে কয়েকশো কোটির বরাদ্দ কি স্রেফ জলেই যাচ্ছে?
আনন্দবাজার | ১০ জুলাই ২০২৫
নিকাশি খাতে প্রতি বছরই বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে লাফিয়ে। কিন্তু, কাজের কাজ কি আদৌ কিছু হচ্ছে? এক রাতের বৃষ্টিতেই কলকাতা শহরের বাসিন্দারা জমা জলে যে ভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছেন, তাতে এই প্রশ্ন করছেন অনেকেই। ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে কলকাতা পুরসভা নিকাশি খাতে খরচ করেছিল ১৭৬ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৬ কোটি ৯ লক্ষ টাকা। আর, চলতি ২০২৫-’২৬ অর্থবর্ষের পুর বাজেটে এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫২ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা।
ফি-বছর বরাদ্দ বাড়ে। কিন্তু বর্ষায় জমা জলে হাবুডুবু খাওয়ার ভবিতব্যে কোনও পরিবর্তন ঘটে না। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিতে ভেসেছিল শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা। কর্মক্ষেত্রে পৌঁছতে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল সাধারণ মানুষকে। অটো, রিকশা বা অ্যাপ-ক্যাবে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া গুনে গন্তব্যে পৌঁছন তাঁরা। অতীতে বৃষ্টির জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুরও একাধিক ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন উঠেছে, একটু ভারী বৃষ্টিতেই যদি জল-যন্ত্রণার ছবিটা প্রতি বছর ফিরে আসে, তা হলে এত টাকা নিকাশির পিছনে কোথায় খরচ হচ্ছে? কলকাতা পুরসভার বিজেপি পুরপ্রতিনিধি সজল ঘোষের অভিযোগ, ‘‘মাটির নীচে তো অন্ধকার। ওখানে কী কাজ হচ্ছে, কে দেখতে যাচ্ছে? মঙ্গলবার শহরের জল থইথই ছবিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, পুরসভার নিকাশি দফতর কী কাজ করেছে!’’
শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় একটু ভারী বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। যেমন, উত্তর কলকাতার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের বিস্তীর্ণ অংশ, মহাত্মা গান্ধী রোড, রবীন্দ্র সরণি, ঠনঠনিয়া, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিটের মতো বিভিন্ন এলাকা। পুরসভার নিকাশি দফতরের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, মহাত্মা গান্ধী রোড এবং আশপাশের এলাকায় জল জমার অন্যতম কারণ মেট্রোর লাইন। নিকাশি দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘লালবাজার স্ট্রিট, সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের নীচ দিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি ইটের বড় নিকাশি নালা। কিন্তু মেট্রোর নির্মাণকাজের সময়ে সেন্ট্রাল স্টেশনের নীচে পুরসভার ওই নিকাশি লাইন ভেঙে দেওয়া হয়। পরিবর্তে ওই অংশে মেট্রোর তরফে আঁকাবাঁকা নিকাশি লাইন তৈরি করা হয়েছে। তাই ভারী বৃষ্টি হলে জল নামতে দেরি হয়।’’ বাকি অংশে জল জমার কারণ, সেগুলি অত্যন্ত নিচু এলাকা।
প্রতি বছর শহরের এই দুরবস্থার জন্য সরকারি উদাসীনতাই দায়ী বলে মনে করছেন পুরসভার প্রাক্তন ডিজি (নগর পরিকল্পনা) দীপঙ্কর সিংহ। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘প্রতি বছর শুধু বর্ষার আগে শহরের খালগুলির সংস্কার নিয়ে টনক নড়ে প্রশাসনের। কেন সারা বছর ধরে খালের সংস্কার করা হবে না? তা হলে তো বর্ষায় এত ভুগতে হয় না।’’ মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহ অবশ্য মনে করেন, মঙ্গলবার জল জমেছে স্রেফ ভারী বৃষ্টির কারণেই। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ৩৫ বছর ধরে কলকাতা পুরসভার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। দশ বছর মেয়র পারিষদ হিসাবে রয়েছি। সোম ও মঙ্গলবার শহরে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা আগে কখনও হয়নি। কেবল যোধপুর পার্কেই সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। শহরের বাকি জায়গায় কমবেশি ১০০ মিলিমিটার করে বৃষ্টি হয়েছে। কয়েক ঘণ্টায় এত বৃষ্টি হলে জল জমবেই।’’ মেয়র পারিষদের দাবি, ‘‘পাঁচ ঘণ্টা ধরে ভারী বৃষ্টি হলেও পুরসভার তরফে দ্রুত জল নামানো হয়েছে। অন্যান্য বছর পাতিপুকুর আন্ডারপাস জলে ডুবলেও এ বারের ছবিটা ছিল আলাদা। পুরসভা বছরভর নিকাশি নালা থেকে পলি তোলার কাজ করেছে বলেই জল দ্রুত নেমেছে।’’
তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো এই শহরের নিকাশি ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলে (১৮৭০-’৮০) তৈরি। শহরের প্রায় ২০০ কিলোমিটার অংশ জুড়ে ইটের তৈরি নিকাশি পথ দিয়ে বৃষ্টির জমা জল বিভিন্ন পাম্পিং স্টেশনে পৌঁছয়। সেখান থেকে বিভিন্ন খালের মাধ্যমে তা বিদ্যাধরী, মাতলা, পিয়ালি নদীতে গিয়ে পড়ে। বৃষ্টির জমা জলের অন্য অংশ সরাসরি গঙ্গায় গিয়ে পড়ে। পুরসভার নিকাশি দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘মানুষ ঢোকার মতো ইটের তৈরি নিকাশি নালা নিয়েই আমাদের যত মাথাব্যথা। সেগুলি মাটির নীচে এমন ভাবে রয়েছে যে, রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন। পলি তুলতে গিয়ে কোথাও ধস নামলে তখনই আমরা কেবল ওই নিকাশি পথ মেরামত করি।’’