মিছিল থেকে পুলিশি ধরপাকড় চলল বহু জায়গায়। কোথাও পুলিশের হাতে চড় খেতে হল ধর্মঘটের সমর্থনে রাস্তায় নামা সিপিএমের নেতাকে। আবার কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে ধস্তাধস্তির মধ্যে এসএফআই নেত্রী চড় মারলেন জোড়াসাঁকো থানার ওসি-কে! রাজ্যে দিনভর ধর্মঘট ‘সফল’ করতে এবং ‘ভাঙতে’ এই রাস্তার লড়াইয়ের শেষে বাধল তীব্র রাজনৈতিক তরজা। কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলির অভিযোগ, দেশ জুড়ে ডাকা সাধারণ ধর্মঘট ভাঙতে কোনও রাজ্যে এমন হামলা হয়নি। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পাল্টা দাবি, রাজ্যের মানুষ ধর্মঘট প্রত্যাখ্যান করেছেন।
শ্রম বিধির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা বুধবারের ধর্মঘট এবং রেল রোকো, রাস্তা রোকো-তে গোটা দেশে ২৫ কোটি মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে দাবি শ্রমিক নেতাদের। তাঁদের বক্তব্য, কয়লা, অন্যান্য খনি, ইস্পাত, ব্যাঙ্ক, বিমা, পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ, ডাক, টেলি-যোগাযোগ, বন্দর, চা-বাগান, চটকল ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন। শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, অনেক বহুজাতিক সংস্থার কর্মীরাও ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন। বিহার, কেরল, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মেঘালয়, মণিপুরের অনেক জায়গাতেই শ্রমিক সংগঠনগুলির ধর্মঘট সর্বাত্মক চেহারা নিয়েছে। বিহারে বিরোধীদের জোট ভোটার তালিকা সংশোধনের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ বিহার বন্ধ’-এর ডাক দিয়েছিল। সেখানে ধর্মঘটের সমর্থনে একসঙ্গে মিছিল করেছেন কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক এম এ বেবি, সিপিআইয়ের ডি রাজা, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, আরজেডি-র তেজস্বী যাদবেরা। দিল্লিতে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা মিছিল করে যন্তর মন্তরে গিয়ে জনসভা করে মোদী সরকারকে নিশানা করেছেন।
শ্রমিক সংগঠনগুলি এবং সংযুক্ত কিসান মোর্চার রাজ্য নেতৃত্ব দাবি করেছেন, বাংলায় পুলিশ-প্রশাসনের ‘দমন-পীড়ন’ মোকাবিলা করে চা-বাগান, চটকল-সহ নানা ক্ষেত্রে ধর্মঘটে ভাল সাড়া মিলেছে। শহরে বেশি সংখ্যায় বাস চালু রেখে রাজ্য সরকার দেখাতে চেয়েছে, ধর্মঘটের কোনও প্রভাব নেই। সিটুর রাজ্য সম্পাদক জিয়াউল আলম বলেছেন, ‘‘দেশের অন্য কোথাও কোনও রাজ্য সরকার এ ভাবে ধর্মঘট ভাঙতে হামলা চালায়নি, যা পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে। তবু শ্রমিক-কর্মচারীরা যে ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, আমরা তাতে আরও শক্তিশালী হয়েছি।’’ পুলিশ যে ভাবে ধর্মঘট ভাঙতে ‘আক্রমণ’ করেছে, তার প্রতিবাদে আগামী তিন দিন রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
রাজ্যে এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য-সহ ১১ জনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করে পুলিশের এই ভূমিকার প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিটু, এআইটিইউসি, এআইসিটিইউ, এআইইউটিসি, আইএনটিইউসি-সহ বিভিন্ন শ্রমিক সংঠনের নেতৃত্ব। দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব বা শাসক দলের নেতারা পুলিশের মা-স্ত্রী’র নাম টেনে হুমকি দেওয়ার সময়ে সক্রিয়তা কোথায় থাকে, সেই প্রশ্ন তুলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় ডাকা ধর্মঘট ভাঙতে রাজ্য সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। একই বক্তব্য সংযুক্ত কিসান মোর্চার রাজ্য শাখার তরফে অমল হালদার, কার্তিক পাল এবং এসইউসি-র সাধারণ সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের। অন্য দিকে, পুলিশকে চড় মারায় এসএফআই নেত্রী বর্ণনা মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জোড়াসাঁকো থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অভিরূপ চক্রবর্তী।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সেলিমের মন্তব্য, ‘‘আগামী ২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে দিল্লির কাছে সাধু সাজছে তৃণমূল! মোদীর বিরুদ্ধে ধর্মঘট, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সক্রিয়! হামলা হয়েছে, গ্রেফতার করেছে, ৮০ বছরের মহিলাকেও ছাড়েনি। আগামী তিন দিন রাজ্যে ধিক্কার কর্মসূচি পালন করা হবে।’’
তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ অবশ্য বলেছেন, ‘‘সিপিএম প্রথম জবাব দিক, কেন কেরলে তাদের সরকার তো ধর্মঘট ব্যর্থ করতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে? তা হলে বাংলায় ৮-১০ জন কেন এ সব করছেন! মানুষ রাস্তায় নেমে বাধা পেলে পুলিশের যা কাজ, তারা তা-ই করেছে। তৃণমূল নামেনি। নামলে এক-দেড় সেকেন্ডও সিপিএম রাস্তায় থাকতে পারত না!’’ প্রসঙ্গত, কেরলে নির্দেশিকা জারি এবং পরিষেবা সচল রাখতে সরকারি পদক্ষেপ করতে হয়েছে হাই কোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে। তৃণমূলের মুখপাত্র সমীর চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্মদিবস নষ্ট করবেন না বলে মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে বন্ধ-ধর্মঘট আর লোডশেডিং রাজ্য থেকে বিদায় নিয়েছে। আর বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে দেশে তিনিই পথপ্রদর্শক। ফলে, ধর্মঘটের মতো বন্ধ্যা রাজনীতির রাজ্যবাসী প্রত্যাখ্যান করেছেন আগেই।’’