• দিল্লিতে বিদ্যুৎ, জল বন্ধ কোচবিহারের মাসুদদের
    আনন্দবাজার | ১০ জুলাই ২০২৫
  • মন ভাল নেই মাসুদের।

    বিরাট কোহলি যার প্রিয় ক্রিকেটার, ভারতের নীল জার্সিটা যার কাছে যখের ধন, সেই সাড়ে দশ বছরের মাসুদ নাকি বাংলাদেশি! আর তাই দিল্লির বসন্তকুঞ্জ এলাকার জয় হিন্দ কলোনিতে দু’দিন ধরে তাদের ‘বিজলি-পানি’ বন্ধ। কানাঘুষোয় মাসুদ শুনেছে, দিল্লির বিজেপি সরকার নাকি তাদের ধরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। বোনের টনসিলে ব্যথা হওয়ায় বাবা-মা বোনকে নিয়ে গিয়েছেন ডাক্তারের কাছে। জুলাইয়ের ভ্যাপসা গরমে ঘরে টিকতে না পেরে তাই মাসুদ বেরিয়ে পড়েছে পাড়ায়। ঘুরে ঘুরে নিজের মতো করে বুঝে নিতে চাইছে ব্যাপারটা। ভারতে জন্মে কী ভাবে সে বাংলাদেশি হয়ে গেল, সেই অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছে না পঞ্চম শ্রেণির মাসুদ।

    আসলে ছোট্ট মাসুদ বুঝবে কী করে, তাদের বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিয়ে, জল-বিদ্যুৎ বন্ধ করার নামে আসলে পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ উঠেছে কিছু রাজনৈতিক মদতপুষ্ট ভূমি-মাফিয়ার বিরুদ্ধে। যাদের লক্ষ্য, বসন্তকুঞ্জের ওই জমি হাতিয়ে তাতে আবাসন তৈরি করে মুনাফা লোটা।

    বসন্তকুঞ্জের সারি সারি আবাসন, মল, ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সীমানা পেরোলেই টিনের বেড়ার আড়ালে নিজেকে স্বেচ্ছায় লুকিয়ে রেখেছে জয় হিন্দ কলোনি। বড় রাস্তা থেকে কিছু বোঝা মুশকিল। ভিতরে ঢুকলেই এবড়োখেবড়ো রাস্তা। এলাকাটি রাজধানী দিল্লির অংশ হলেও, তাতে কোনও কালে পিচ পড়েছে বলে মনে হয় না। বর্ষার কারণে সেই রাস্তায় আধ-মানুষ সমান গর্ত। চারিপাশে আবর্জনার পাহাড়। স্থানীয়দের পেট চলে ওই আর্বজনা কুড়িয়ে। ঘিঞ্জি ওই এলাকায় পায়রার খোপের মতো ঘর। জানলা বলে কিছু নেই। স্থানীয়দের অধিকাংশই কোচবিহারের বাসিন্দা। গত ১৫-২০ বছর ধরে যাঁরারয়েছেন এখানে।

    বিতর্কের সূত্রপাত হয় গত কাল। স্থানীয় বাসিন্দা আয়েষা জানান, “সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ বিদ্যুৎ বিভাগের লোকেরা এসে মূল মিটারের তার কেটে দিয়ে যায়। সমর্থ পুরুষ-মহিলারা সকলেই তখন কাজে। তাই আটকানোর কেউ ছিল না। অথচ আমাদের সকলের বিদ্যুতের বকেয়া মেটানো আছে।” বিষয়টি নিয়ে আজ সন্ধ্যায় স্থানীয়দের নিয়ে বৈঠক করেন স্থানীয় নেতা মন্টু প্রধান। ঠিক হয়েছে, বিদ্যুৎ সংস্থার ওই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হবেন তাঁরা।

    স্থানীয়রা জানালেন, জয় হিন্দ কলোনিতে একটি মন্দির ও মসজিদের মূল মিটার থেকে বাসিন্দাদের ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হত। মূল মিটার কেটে দেওয়ায় গত কাল সকাল থেকে গোটা এলাকা বিদ্যুৎহীন। আয়েষার পাশেই আট মাসের মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে সাইমা। দুধের ওই শিশুর সারা শরীরে ঘামাচি। আয়েষার প্রশ্ন, “এত ছোট বাচ্চা এই গরমে পাখার হাওয়া ছাড়া থাকতে পারে?” পাঁচ দিনের একটি শিশুর গরমে শরীর খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করতে হয়েছে। গর্ভবতী কিছু মহিলা চলে গিয়েছেন আশপাশের আত্মীয়দের বাড়িতে। গত কাল জলের ট্যাঙ্কার না আসায় বোতলের জলেই যাবতীয় কাজ সেরেছেন বাসিন্দারা। আজ ট্যাঙ্কার এলে জারিকেনে স্নানের জল ভরে আনবেন বলে ঠিক করেছিলেন আবু হোসেন। বেলা আড়াইটের সময়ে ফিরলেন খালি বোতল নিয়ে। লুঙ্গির গেঁজ থেকে বিড়ি বার করে ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, “দিল্লিতে বিজেপি আসার পর থেকে এ সব শুরু হয়েছে। আমরা বাংলায় কথা বলি— এটাই তো আমাদের অপরাধ।”

    দিল্লির জয় হিন্দ কলোনি ব্যতিক্রম নয়। কখনও রাজস্থান, কখনও বাড়ির পাশের ওড়িশা, কখনও কর্নাটক— বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। চলছে ধরপাকড়। গ্রেফতারও করা হচ্ছে। আর মুসলিম হলে তো কথাই নেই। সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ শালিমারবাগ থেকে এমন ছ’জন মুসলিমকে বাংলাদেশি সন্দেহে গ্রেফতার করে। বেশ কিছু দিন আটকে রাখার পরে যাবতীয় প্রমাণ দেখে শেষ পর্যন্ত তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিদের হেনস্থা নিয়ে একাধিকবার সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের মতে, জয় হিন্দ কলোনির ঘটনায় উদ্বিগ্ন নবান্নও। শুরু হয়েছে খোঁজখবর নেওয়া। এক্স হ্যান্ডলে আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝা-ও গোটা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

    কিন্তু দিল্লিতে ভোটের আগে যেখানে জয় হিন্দ কলোনির বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব পরীক্ষা হয়েছে, সেখানে কেন ফের বাংলাদেশি তত্ত্ব? স্থানীয় বাসিন্দা স্বপ্না বর্মণ বলেন, ‘‘এখানে হিন্দু-মুসলিম যাঁরা থাকেন, তাঁদের অধিকাংশ কোচবিহারের বাসিন্দা। সামান্য কিছু ঘর অসমিয়া থাকেন। আমাদের সকলের গত ডিসেম্বরে নথি পরীক্ষা হয়। দিল্লি ও কোচবিহারের যা প্রমাণ্য নথি ছিল, সব দেখানো হয়। যাঁদের নথি নিয়ে সংশয় হয়েছিল, তাঁদের কোচবিহারের পৈতৃক গ্রামে গিয়ে যাচাই করে এসেছে দিল্লি পুলিশ। পরে দিল্লি পুলিশ স্বীকার করেছে, এখানে কোনও বাংলাদেশি থাকেন না।’’

    কিন্তু এ যাত্রায় দেশ জুড়ে বাংলাদেশি তাড়াও-এর ধুঁয়ো ওঠার সুযোগ নিয়ে আসলে জয় হিন্দ কলোনির ঝুগ্গি-ঝুপড়ির দখল নেওয়ার কৌশল নিয়েছে কিছু সুবিধাবাদী। স্থানীয়দের মতে, তাঁরা যে জমিতে থাকেন, সেই জমির দখলদারি নিয়ে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ) ও জমির আদি মালিকদের মধ্যে মামলা চলছে। দু’পক্ষই বসন্তকুঞ্জের মতো বর্ধিষ্ণু এলাকার ওই জমির দখন নিয়ে আবাসন-মল বানাতে চাইছেন। দু’পক্ষের বিবাদে ফ্যাসাদে পড়েছেন প্রায়১২০০-১৪০০ বাঙালি।

    অধিকাংশ পুরুষই এখানে আর্বজনা সংগ্রহ করে দিন গুজরান করেন। মহিলারা সকলেই আশপাশের আবাসনে গৃহসহায়িকার কাজ করেন। স্থানীয়দের কথায়, তাঁদের যদি সরে যেতে হয়, তা হলে দক্ষিণ দিল্লির আর্বজনা সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যাবে। গৃহসহায়িকা অমিল হবেঅবস্থাপন্নদের পরিবারে।

    দু’দিন স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে পারেনি মাসুদ। তাই সে স্কুলেও যেতে পারছে না। হাতে গোনা দু’টি বন্ধু আছে তাঁর। মৃণাল ও ফিরোজ। মাসুদের আকুতি একটাই, তাড়াতাড়ি বিজলি ফিরুক। হোমওয়ার্ক সেরে স্কুলে যাবে সে। মৃণাল ও ফিরোজের সঙ্গে কত দিন দেখা হয়নি তার!
  • Link to this news (আনন্দবাজার)