• বেঁকে যাচ্ছে শিশুদের মেরুদণ্ড, দুষ্কর রোগ নির্ধারণ, চিন্তায় চিকিৎসক মহলে! কোন পথে নিরাময়?...
    আজকাল | ০৮ জুলাই ২০২৫
  • গোপাল সাহা: স্কলিওসিস শিশুদের এমন একটি রোগ যা পূর্বে নির্ধারণ বা ডায়াগনোসিস করা দুষ্কর, চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে চিকিৎসা জগতে। চিকিৎসকরা শিশুদের এই রোগ প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় চালিয়ে যাচ্ছে একাধিক পদক্ষেপ। তথাপি দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে এই রোগটিকে পূর্বেই নির্ধারণ করা। এর কারণে আক্রান্ত হচ্ছে প্রথম চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা কিংবা তার থেকে একটু বড় ১০ থেকে ১২ বছর বয়স কালে। ভয়ংকর পরিণতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এই সমস্ত শিশু ও তাদের পরিজনদের।আর এই শিশুদের মেরুদণ্ডের বক্রতা (স্কলিওসিস) সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছেন শহর কলকাতার একাধিক খ্যাতনামা চিকিৎসকরা, সঙ্গে রয়েছে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (IAP), ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (WBAP) এবং স্পাইন রিসার্চ ফাউন্ডেশন (SRF)।  যাদের যৌথভাবে আজ কলকাতায় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি আয়োজিত হয় সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে।  যাদের মূল লক্ষ্য ছিল শিশু চিকিৎসকদের স্কলিওসিস সম্পর্কে সচেতন ও দক্ষ করে তোলা, যাতে তারা প্রাথমিক পর্যায়েই রোগটি শনাক্ত করতে পারেন। যথাযথ চিকিৎসা পরামর্শ দিতে পারেন এবং প্রয়োজনে দ্রুত স্পাইন বিশেষজ্ঞদের কাছে রেফার করতে পারেন। শিশু চিকিৎসক ও মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞদের এই যৌথ মঞ্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করছে—স্কলিওসিসে আক্রান্ত শিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা।

    প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক 'মিহির সরকার' বলেন, “শিশুদের মধ্যে স্কলিওসিস যদি যথাসময়ে শনাক্ত না হয় এবং চিকিৎসা না হয়, তাহলে তা শারীরিক ও মানসিকভাবে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। এর প্রতিকার হলো আগেভাগে সনাক্তকরণ ও সমন্বিত চিকিৎসা। এই সেমিনার আমাদের সেই দিকেই একটি ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ,”।

     চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের চিন্তার প্রধান কারণগুলো এবং এদিনের আলোচনায়  আলোকপাত করা বিষয়গুলি হলো :

    * শিশুদের মধ্যে স্কলিওসিসের প্রাথমিক লক্ষণ চেনার উপায়

    * কখন ও কীভাবে হস্তক্ষেপ করা উচিৎ

    * রক্ষণশীল ও অস্ত্রোপচারভিত্তিক চিকিৎসার সাম্প্রতিক অগ্রগতি

    * শিশু ও পরিবারের জন্য মানসিক সহায়তা ও পরামর্শ

    * শিশু চিকিৎসা ও স্পাইন কেয়ার সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলার মাধ্যমে এই উদ্যোগের লক্ষ্য untreated স্কলিওসিসের বোঝা কমানো। সমগ্র শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো এবং এমন একটি চিকিৎসা পরিবেশ গড়ে তোলা, যেখানে আগেভাগে হস্তক্ষেপই প্রাধান্য পায়।

    এডোলেসেন্ট ইডিওপ্যাথিক স্কোলিওসিস (Adolescent Idiopathic Scoliosis) (AIS) সবচেয়ে সাধারণ স্কলিওসিস। এটি মূলত কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে দেখা যায় এবং ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি আক্রান্ত হয়। এর প্রাদুর্ভাবের হার ০.৪৭% থেকে ৫% পর্যন্ত হতে পারে।

    স্কলিওসিসের মৃদু রূপে অনেক সময় শুধুমাত্র পিঠে ব্যথা থাকতে পারে এবং তা সহজে চোখে পড়ে না। যদি সময়মতো শনাক্ত না হয়, তাহলে এটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং গুরুতর শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে, যেমন —

    1. শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা (respiratory disease)

    2. হৃদরোগ (cardiac complications)

    3. অস্বাভাবিক হাঁটা-চলা বা চলাফেরায় জটিলতা (abnormal gait)

    ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে, স্কলিওসিস প্রায়ই বিভিন্ন জেনেটিক রোগের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যেমন:

    * স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (Spinal Muscular Atrophy)

    * মাসকুলার ডিসট্রোফি (Muscular Dystrophy)

    * নিউরোফাইব্রোমাটোসিস (Neurofibromatosis)

    * মিউকোপলিস্যাকারাইডোসিস (Mucopolysaccharoidosis) ইত্যাদি।

    এইসব ক্ষেত্রে রোগ দ্রুত ও গুরুতরভাবে বাড়ে, এবং অল্প বয়স থেকেই চিকিৎসা ও সহায়তার প্রয়োজন হয়।

    এদিন আমাদের সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক 'সংযুক্তা দে' বলেন, "এ ধরনের রোগ শিশুদের মধ্যে অর্থাৎ কোন পড়ুয়াদের মধ্যে বিনা কারণ বসতই লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা (ইডিওপ্যাথিক স্কোলিওসিস), রাজ্য তথা দেশে এক থেকে দুই শতাংশ শিশুদের মধ্যে এ ধরনের রোগ আক্রান্ত হতে পারে সারা জীবনের জন্য। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে underline থাকে। যেমন, স্পাইনো মাসকুলার এট্রফি বা নিউরো মাসকুলার ডিজিজ থাকলে এ ধরনের রোগ হওয়ার চান্স বেশি, আর আমরা তার দিকে বেশি করে নজর রাখি।  তবে অনেক ক্ষেত্রে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগ পিঠে নিতে গিয়ে ব্যথা হয় বা বাড়ন্ত বাচ্চাদের নানা রকম ব্যথা হয় অর্থাৎ মেরুদন্ড বা হারে ব্যথা, যা অনেক সময় আমরা নজর দেই না। যা ভবিষ্যতে বড় আকার ধারণ করতে পারে অথবা মেরুদন্ড বেঁকে যেতে পারে। যা ভয়াবহ বিপদজনক পরিণতি হতে পারে। এ ধরনের বিষয়কে কোনভাবেই নজরান্দাজ না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা খুব জরুরী।" 

    এই বিষয়ে আমরা সরাসরি কথা বলেছিলাম প্রখ্যাত চিকিৎসক সৌমজিৎ বাসুর সঙ্গে। তিনি বলেন, "অনেক রকম কারণে বাচ্চাদের মধ্যে স্কোলিওসিস হয় আবার কখনো অকারণেও হয়। অনেক ক্ষেত্রে কারণ জানা যায় না যাকে আমরা ইডিওপ্যাথিক বলি।" এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, "কখনো জন্মগত কারণে হয় যাকে আমরা কনজেনিটাল বলি, কখন আবার মাংসপেশী বা স্নায়ু রোগের কারণে হয় যাকে আমরা নিউরোমাসকুলার বলি। এ ধরনের বাচ্চাদের বড় হবার সাথে সাথে শিরদার আর বিকৃতি হয়। যার ফলে শারীরিক নানাবিধ জটিল সমস্যা এমনকি বুকের খাঁচা পর্যন্ত বিকৃত হয়ে যায়। যার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস বা হৃদ জনিত ভয়ানক রোগ জন্ম নেয়। আবার এই ধরনের রোগে আক্রান্ত শিশুদের শিকদার আর নিচের দিকে ব্যথা হয় এবং ভবিষ্যতে তা দেখে যেতে পারে ধনুকের মত। মূলত এ ধরনের সমস্যা হলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ ও রোগ নিরাময়ের একমাত্র উপায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই রোগ নির্ণয় করা এবং চিকিৎসা শুরু করা। কোনরকম গাফিলতি বড় ভয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে।"

     
  • Link to this news (আজকাল)